২২ শে জুন ১৯৪১ সালে নাৎসী বাহিনী সোভিয়েত রাশিয়ায় অপারেশন বারবারোসা পরিচালনা করে। এটি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় পরিচালিত সকল অভিযান থেকে সবচেয়ে ভয়ানক অভিযান হিসেবে গন্য করা হয় যা রাশিয়ান জনগণদের সবচেয়ে আতংকিত করেছিল।
এই আক্রমণটি ব্লিটজক্রেইগ মেথডের উপর করা হয়েছিল। এটি এমন একটি যুদ্ধ কৌশল যেখানে আক্রমণকারী সেনারা তাদের আর্মার কোর, মেকানাইজড ইনফেন্ট্রী কোর, এয়ার সাপোর্ট এর সমন্বিত ঝটিকা আক্রমণ এর মাধ্যমে শত্রু সেনার প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে মুল অংশে ঢুকে পড়ে। হিটলার এই আক্রমণ সম্পর্কে বলার সময় বলেছিলেন –“যখন রাশিয়ার উপর জার্মান আক্রমণ শুরু হয়েছিল তখন সারা পৃথিবীর মানুষের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছিল!”
জার্মান সেনারা তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে এই আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। ফিল্ড মার্শাল ভন লিব, ভন বক, ভন রান্সডেটের এর অধীনে যথাক্রমে উত্তর গ্রুপ, সেন্টার গ্রুপ, দক্ষিণ গ্রুপ এর দায়িত্ব পড়ে। রাশিয়া চারটি ইউনিটের মাধ্যমে এই সেনাদের মোকাবেলা করে।
জার্মানি সর্বমোট ১১৭ টি(রুমানিয়ান ও হাংগেরিয়ান সৈন্য ছাড়া) ডিভিশন সেনা মোতায়েন করে এই আক্রমণ এর জন্য। অপরদিকে রাশিয়া ৩৪ টি আরমার্ড ডিভিশন সহ ১৩২ ডিভিশন সেনা মোতায়েন করে এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য।
রাশিয়া আক্রমণ এর পরিকল্পনা ১৯৪০ সাল থেকেই করা হয়েছিল। এটা নিয়ে তখন হিটলার এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে তখন তিনি ব্রিটেন আক্রমণ এর আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪০ সালের আগস্টে মার্ক্স সর্বপ্রথম এই আক্রমণ এর পূর্ণাংগ ছক তৈরী করেন। আর পরিকল্পনায় প্রধান টার্গেট ছিল মস্কো। এর পরে ছিল কিয়েভ। তিনি বাল্টিক এর দিকে লেলিলগ্রাড এবং দক্ষিণের মলদাভিয়াতে মাস্কিং এটাক করতে চাইছিলেন। মস্কো বিজয়ের পর তার প্ল্যান ছিল দক্ষিণের সাথে কিয়েভও এটাক করবেন। তার কাছে লেলিনগ্রাড দ্বিতীয় সারির ইস্যু ছিল।
রাশিয়া আক্রমণ এর দ্বিতীয় পরিকল্লনার ছক কষের হ্যাল্ডার একই বছর ডিসেম্বর মাসে। তিনি মার্ক্স এর প্ল্যান পরিবর্তন করেন, ত্রি -মুখী আক্রমণ এর ছকের মাধ্যমে। তিনি মস্কো ও লেলিনগ্রাডে বড় অভিযান এবং কিয়েভে ছোট অভিযানের পক্ষে ছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল মস্কো আর লেলিনগ্রাড দখলের পর তিনি আর্চাংগেল এ আক্রমণ চালাবেন এবং কিয়েভ পতনের পর ভলগা অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হবেন।
হিটলার সবার শেষে তার নিজস্ব আক্রমণ ছক প্রণয়ন করেন এবং সেটিই চুড়ান্ত করেন এবং ডিসেম্বর মাসেই। নাম দেন “অপারেশন বারবারোসা“। যদিও তার পরিকল্পনায় তার অনেক জেনারেলদেরই আস্থা ছিল না। কিন্ত কারো মুখ ফুটে সে কথা বলার সাহস ছিল না তার বিরুদ্ধে। যাই হোক হিটলার এর প্রধান লক্ষ্য ছিল উত্তরের লেলিনগ্রাড। তাছাড়া তার দক্ষিণের আক্রমণ এর জন্য তিনি বাধ্য হয়েছিলেন ইউক্রেন দখল করতে!
২২ শে জুন ১৯৪১ রবিবারে রাত ৩ টার দিকে জার্মানরা তাদের অভিযান শুরু করে। জার্মান আর তার মিত্র শক্তি মিলিয়ে ৩ মিলিয়ন পদাতিক সেনা, ৩৫৮০ টি ট্যাংক, ৭১৮৪ টি আর্টিলারি গান, ১৮৩০ টি ফাইটার প্লেন এবং ৭৫০০০০ টি ঘোড়া সহযোগে আক্রমণ শুরু হয়।
এত সংখ্যক সেনা আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একযোগে এত বিশাল আক্রমণ এর আগে কোথাও দেখা যায় নি। তাছাড়া হঠাৎ এত ম্যাসিভ এটাকের ফলে জয়ের পাল্লাটা হিটলারের দিকেই ছিল!
১৭ দিনের আক্রমণে ৩০০০০০ সৈন্য ধরা পড়ে, ২৫০০ ট্যাংক, ১৪০০ আর্টিলারি গান এবং ২৫০ ফাইটার প্লেন ধ্বংস হয় রাশিয়ানদের।
এটা ছিলা আর্মি গ্রুপ সেন্টার এর আঞ্চলিক অভিযান। যেকোন সামরিক বিশ্লেষকদের মতে রাশিয়ান সেনাবাহিনী অনেকটা ভেঙে পড়েছিল এবং মস্কোও পতনের দ্বারপ্রান্তে ছিল। এমনকি, জার্মানরা এত দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলো যে তারা পুরো সেনাদলের লজিস্টিক সাপ্লাই এবং কমিউনিকেশন বাধাগ্রস্ত করেছিল। আর্মি গ্রুপ সেন্টার ডেসনাতে গিয়ে থামে। তাদের কাছে এই বিরতিটা চরম গতিময়তার মাঝে একটু আরামে নিশ্বাস ফেলার মতই ছিল।
এই যুদ্ধে অক্ষসেনা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাদের সর্বপ্রধান সেনানায়ক হিটলার এর হঠকারী সিদ্ধান্তে। তিনি আর্মি সেন্টার গ্রুপকে নির্দেশ দেন তাদের অধীনে থাকা প্যাঞ্জার গ্রুপ( ট্যাংক বহর) দক্ষিণ -পূর্বে কিয়েভের দিকে যাওয়ার জন্য। ১ প্যাঞ্জার গ্রুপকে উত্তরের দিকে যাওয়ার জন্যও নির্দেশ দেন। এতে করে আর্মি গ্রুপ সেন্টার দুর্বল হয়ে পড়ে। প্যাঞ্জার গ্রুপের কমান্ডার জেনারেল গুদেরিয়ান হিটলার এর এই সিদ্ধান্ত কে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু একরোখা হিটলার তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকেন। তাই তিনি গুদেরিয়ানের কথা শুনেননি।
এটি হিটলারের জন্য অনেক কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল যে স্ট্যালিন লাইন ভেঙে এগিয়ে যাওয়া অক্ষসেনারা কোন দিকে যাবে সেটি নিয়ে। তারা কি উত্তরে যাবে নাকি দক্ষিণে নাকি পূর্বে??
প্রথম দিকে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া নাৎসী সেনা বিপুল সংখ্যক রাশিয়ানদের বন্দী করে এবং হার্ডওয়্যারের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। কিন্তু হিটলারের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করার দরুন অক্ষসেনার ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীতকাল চলে আসে। প্রচন্ড ঠান্ডা, তুষারপাত, বৃষ্টিতে নাজেহাল হতে থাকে হিটলার বাহিনী।
হিটলার চাইছিল উপরোক্ত অঞ্চলগুলো দখল করে সেখানকার লোকদের সরিয়ে জার্মান সেটেলার ঢুকিয়ে সে অঞ্চল নিজেদের করে নেয়া (বর্তমানে ইসরাইল ফিলিস্তিন এ যেমনটি করছে) এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা। কিন্তু সময়মত মস্কো এটাক না করে কিয়েভ, ইউক্রেন আক্রমণ, প্রতিপক্ষকে দুর্বল ভাবা, দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানে ব্যর্থতা, লাগাতার যুদ্ধ করা, রাশিয়ার আবহাওয়া, রাশিয়ানদের লাগাতার যুদ্ধ অব্যাহত রাখা সব মিলিয়ে প্রথম দিকে চরম আগ্রাসন চালিয়ে আসা অক্ষসেনারা শেষদিকে একে চরম মার খেতে থাকে এবং পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়।
লেখায়ঃ আব্দুল্লাহ স্বর্ণাভ ও এডমিন কর্তৃক সংযোজিত
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.