সোভিয়েত নৌবাহিনীতে নৌ-বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে বাল্টিক সাগরে অবস্থানরত সোভিয়েত নৌ বহরের একটি যুদ্ধজাহাজে। 

১৯৭৫ সালের ৯’ই নভেম্বর রাতে জাহাজের দ্বিতীয় প্রধান অফিসার সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি ভ্যালেরি সাবলিন জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি কমিউনিস্ট বিপ্লব শুরু করতে তিনি কয়েকজন নাবিককে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে সেই কামরায় তালা লাগিয়ে দেন। 

অন্য একটি কামরায় জাহাজের প্রধান ইঞ্জিনিয়ার বোরেস গিন্ডেন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন কে তালাবন্ধ করে রাখেন। এবং জাহাজে অবস্থানরত বাকি সদস্যাদের নিয়ে একটি বৈঠকে বসেন। তিনি সেখানে বর্তমান সরকার কতটা দুর্নীতিগ্রস্থ, দেশের মানুষ কতটা কষ্টে আছে এবং বিভিন্ন কিছু বলে নৌ-সদস্যদের ব্রেইন ওয়াশ করতে লাগলেন। এবং বললেন তিনি সেখান থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাবেন এবং রেডিওতে দেশের মানুষের জন্য ভাষন দিতে চান। তার ধারনা ছিলো তিনি একটি নৌ-বিপ্লব শুরু করতে যাচ্ছেন, যার ফলে দেশের সরকারের পরিবর্তন আসবে। তিনি তার পিস্তল টি হাতে নিলেন এবং বললেন যে তার সাথে যেতে রাজি নয়, তার কোনো প্রয়োজন নাই! 

তিনি জাহাজে অবস্থানরত নৌসেনা দের বাধ্য করলেন একটি মুভি দেখতে, যেটি ১৯০৫ সালের নৌ-বিপ্লবকে কেন্দ্র করে তৈরী করা হয়েছিলো। এই মুভি দেখার পর অনেক সৈন্যদের মন জয় করলেন সাবলিন। কিন্তু কেউ পরের কথা চিন্তা করলেন না, যে পরে কি হতে পারে। 

জাহাজ যখক রিগা বন্দরে নোঙ্গর করলো তখন এক জুনিয়র অফিসার সমস্ত পরিকল্পনা কতৃপক্ষের কাছে ফাস করে দিলেন। সাবলিন এই কথা শোনার পর গভির রাতে বন্দর ছেড়ে জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। বিদ্রোহের খবর যখন মস্কোতে পৌছুলো তখন কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না কারন সাবলিন ছিলেন অন্যরকম এক চরিত্রের অধিকারী এবং একজন অনেক ভালো মানুষ, তাই তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয় আবার কেউ কেউ রাগের আগুনে জ্বলতে লাগলেন। 

কতৃপক্ষ ধারনা করেছিলেন যে, জাহাজ টি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তখন বাল্টিক নৌ-বহরকে নির্দেশ দেয়া হলো জাহাজ টির সন্ধান করতে এবং যে কোনো মূল্যে জাহাজটির পথ রোধ করতে। একটু পরেই সোভিয়েত নৌবহরের বিমান তাদের সন্ধান পেলো এবং জাহাজটির সাথে যোগাযোগ করে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করার জন্য বলা হলো। অনেক চেষ্টার পরেও যখন কোনো সু-সংবাদ পাওয়া গেলো না, তখন সেই জাহাজ টিকে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো বিমান বাহিনীকে কিন্তু বিমানবাহী সেই জাহাজ কে ডুবিয়ে দিতে অস্বীকার করলো এবং বললো আমরা আমাদের সহকর্মী দের হত্যা করতে পারবো না। 

এই কথা শুনে সোভিয়েত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রচুর রেগে গেলেন এবং বিমান বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন বিদ্রোহী জাহাজে হামলা করে ডুবিয়ে দেয়ার জন্য। বোমারু বিমান ইতোমধ্যে টেক অফ করেছে এবং বিমান বাহিনী হামলা করার জন্য সমস্ত প্রস্তুতি গ্রহন করছে এবং নৌবাহিনীর জাহাজ চতুর্দিকে সেই বিদ্রোহী জাহাজটিকে ঘিরে ফেলেছে।

এমন সময় কয়েকজন ভীতু বিদ্রোহী জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার বোরেস গিন্ডেন কে মুক্ত করে দিলেন। জাহাজের ক্যাপ্টেন চিফ ইঞ্জিনিয়ার বোরেস গিন্ডেন কে একটি বন্দুকহাতে নিয়ে ইঞ্জিন রুমে যেতে বললেন এবং জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন।

বোরেস গিন্ডেন একটি বন্দুক হাতে ইঞ্জিন রুমে গিয়ে নাবিকদের দিকে বন্দুক তাক করলেন। এবং নাবিক গন তার রক্ত চক্ষু দেখে বুঝতে পারলো তিনি জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলছেন। অতপর ক্যাপ্টেন একটি বন্দুক নিয়ে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে প্রবেশ করেই বিদ্রোহী সাবলিনের হাটুতে গুলি করলেন এবং জাহাজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করে রেডিওতে কতৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করলেন যাতে জাহাজে হামলা করা না হয় এবং তিনি জাহাজের গতি কমিয়ে দেন।

যখন জাহাজের গতি কমে এসেছে তখন বিমান বাহিনীকে হামলা বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়া হলো। সোভিয়েত নৌবাহিনী জাহাজের নিয়ন্ত্রন পাওয়ার পর জাহাজে অবস্থানরত সকল নৌসেনা দের আটক করা হয়। সাবলিন কে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং অন্যান্য অভিযুক্ত দের বিভিন্ন মেয়াদে কারাবাস দেয়া হয়। এভাবেই পতন ঘটে একটি বিভৎস নৌ-বিদ্রোহের।

চীফ ইঞ্জিনিয়ার বোরেস গিন্ডেন এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন সহ যারা বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়েছিলেন তাদেরকে বরখাস্ত করা হয় কেনো তারা বিদ্রোহ টেকাতে পারেন নি এই অভিযোগে। ইঞ্জিনিয়ার বোরেস গিন্ডেন কে আর কোনো দিন নৌবাহিনীতে পাঠানো হয়নি। এই ঘটনার দুই বছর পর ইঞ্জিনিয়ার বোরেস গিন্ডেন নৌবাহিনী থেকে বিদায় নেন। বিদায় মুহুর্তে তাকে গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নিতে হয়। 

এর কিছুদিন পর বোরেস গিন্ডেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং কোল্ড ওয়্যার শেষে তিনি সেই বিভৎস নৌ-বিদ্রোহের কথা লেখেন মিউটিনি নামক একটি বইয়ে এবং এই নৌ-বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই তৈরী করা হয় হলিউড এর The Hunt For Red October Cast সিনেমাটি।

Facebook Comments

comments