পৃথিবীর প্রথম ব্যালেস্টিক মিসাইল হচ্ছে জার্মানির তৈরি ভি-২ ব্যালেস্টিক মিসাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির বানানো এই মিসাইলকে সমগ্র মিসাইল জগতের জাতির পিতা বলা যায়। এটি বিশ্বের প্রথম গাইডেড ব্যালেস্টিক মিসাইল।

২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ছিল মিত্রবাহিনীর জন্য সাক্ষাত যমদূত। তখনকার সময়ে কেউ এধরনের অস্ত্রের কথা কল্পনাও করেনি। তাই জার্মান মিসাইলগুলো যখন মিত্রবাহিনীর ক্যাম্পে আঘাত করত তখন মিত্রবাহিনী প্রথম প্রথম বুঝতে পারত না ঠিক কোন ধরনের অস্ত্র তাদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। তাই উর্দ্ধতন অফিসারের কাছে তারা রিপোর্ট করত যে এক ধরনের গ্যাস ভর্তি পাইপ আকাশপথে উড়ে এসে তাদের ঘাটিগুলোতে আঘাত করছে।

তারা প্রতিবেদনে জানায় এধরনের আক্রমন এত বেশী ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হচ্ছে যে এরকম হামলা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে লন্ডন শহর বসবাসের উপযোগী থাকবেনা এবং শীঘ্রই মিত্রবাহিনীর পরাজয় ঘটবে। ফলে মিত্রবাহিনীর জেনারেলদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বৃদ্ধি পায়।

আসলেই সেই যুগে ১০০০ কেজি ওয়ারহেড নিয়ে ৮৮ কি.মি. উচ্চতায় শব্দের চেয়ে কয়েকগুন বেশী দ্রুতগতিতে উড়ে গিয়ে ৩২০ কি.মি. দূরে নিখুঁত আঘাতকারী এই অস্ত্রকে থামানোর মত প্রযুক্তি পৃথিবীতেই ছিল না। তাই অপ্রতিরোধ্য এই মিসাইলটির প্রতি হিটলার এতই আগ্রহী ছিলেন যে এই মিসাইলের প্রোডাকশন লাইন দিনে ২৪ ঘন্টাই চালু থাকত। আর কেউ কাজ করতে করতে ক্লান্ত হলে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হত। এমনকি কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে থাকার কারনে অনেকে গুলিও খেয়েছে। ফলে মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই এরকম ২০০০+ মিসাইল বানানো হয়।

এত বিপুল সংখ্যক মিসাইল বানানোর ফলে জার্মানিতে জ্বালানি সংকট হয়। এই মিসাইলের জ্বালানির প্রধান উপাদান ছিল ইথানল। যুদ্ধের সময় জার্মানিতে ইথানলের অভাব দেখা দেয়। তাই জ্বালানি হিসেবে আলু থেকে বায়োফুয়েল বানিয়ে ইউজ করা হত।

এভাবে শত শত মিসাইল বানানোর পর সেগুলো দিয়ে ব্রিটেনে হামলা করা হত। কারন, ভৌগলিকভাবে ব্রিটেনের অবস্থান জার্মানি থেকে এতটা দূরে ছিল যে জার্মানির বোমারু বিমানগুলি ব্রিটেনে পৌছে বেশীক্ষন বোম্বিং এর সুযোগ পেত না। তাই ব্রিটেনকে শায়েস্তা করতে জার্মানি এই মিসাইলের সাহায্য নিত। মিসাইলগুলো বিমানের চেয়ে বেশী ওজনের বোমা নিয়ে হামলা করতে পারত।

এভাবে ক্রমাগত হামলার মুখে লন্ডন শহর দ্রুত ধ্বংস হতে থাকে। যেহেতু এই মিসাইলকে থামানোর মত কোন প্রযুক্তি পৃথিবীতে ছিল না তাই মিত্রবাহিনী ডাবল এজেন্টের মাধ্যমে জার্মানির কাছে তথ্য পাঠায় যে ভি-২ মিসাইলগুলো টার্গেট থেকে ১০-১২ কি.মি. দূরে পড়তেছে। ডাবল এজেন্টের ভুয়া তথ্যের ফাদে পড়ে জার্মানি পরেরবার থেকে লক্ষ্যবস্তুর ১০-১২ কি.মি. সামনের জায়গা টার্গেট করে মিসাইল হামলা শুরু করলে লন্ডন শহর এই মিসাইলের আঘাত ঠেকাতে সমর্থ হয়।

পরবর্তীতে মিত্রপক্ষের বিজয়ের পর ডিজাইনহ এই মডেলের প্রচুর মিসাইল এবং মিসাইল বানানোর সরঞ্জাম মিত্রপক্ষের হাতে চলে যায়। পরবর্তীকালে সেসবের উপর গবেষণা করে আমেরিকা, রাশিয়া, তুরস্ক, ফ্রান্স ও ব্রিটেন ব্যালেস্টিক মিসাইলের সফল পরীক্ষা চালায়। তবে তুরস্ক পরবর্তীতে ব্যালেস্টিক মিসাইল গবেষণা বাদ দেয়।

এই ভি-২ মিসাইলের কারনেই আজ আমরা মংগল গ্রহে অভিযান চালাতে পেরেছি, এই মিসাইলের কারনেই আজকে আপনি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে পেরেছে। কারন এটি মানবনির্মিত প্রথম বস্তু যা মহাকাশে পৌছাতে সক্ষম হয়েছিল। আবার এই ভি-২ মিসাইলের কারনেই বিশ্বে অনেক ক্ষতিকর হামলা চালানো সম্ভব হচ্ছে। কারন আজকের সকল প্রাণঘাতী মিসাইলের পূর্বপুরুষ হচ্ছে এই ভি-২ ব্যালেস্টিক মিসাইল।

 

ভি-২ মিসাইল নিয়ে কিছু ছবিঃ

V-2 Missile

ফাদার অফ ব্যালিস্টিক মিসাইল- ভি-২

V-2 Missile

ভি-২ মিসাইল লাঞ্চার

V-2 Missile

উৎক্ষেপনের আগে সৈন্যদের দ্বারা ভি-২ মিসাইল এর পজিশনিং করা হচ্ছে

V-2 Missile

ভি-২ মিসাইল উৎক্ষেপনের দৃশ্য

V-2 Missile

ভি-২ মিসাইল উৎক্ষেপনের পজিশনে ইঞ্জিনের ফায়ার দ্বারা তৈরি হওয়া গর্ত

V-2 Missile

ভি-২ মিসাইলের আঘাত হানার দৃশ্য

V-2 Missile

ভি-২ মিসাইল লন্ডন শহরে আঘাত হানার পর ধ্বংসপপ্রাপ্ত এলাকার দৃশ্য

V-2 Missile

আঘাত হানার পর ভি-২ মিসাইলের অবশিষ্টাংশ, চায়না টাউন, ইস্ট লন্ডন, মার্চ ১৯৪৫

Facebook Comments

comments