নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে বাংলা ভাষা কেবলই বাঙালি বা বাংলাদেশের মানুষেরই একমাত্র ভাষা নয়। বাংলাদেশের সীমানা থেকে বহু দূরে, প্রায় ১৫ হাজার মাইল দূরে অনেকের কাছেই অপরিচিত আফ্রিকার একটি দেশের প্রধান অফিসিয়াল ভাষাও বাংলা।
কিভাবে এটা সম্ভব হল?
সেই অবিশ্বাস্য ও অসম্ভবকে সম্ভব করার কথাই আজ বলবো।
আমরা যদি মনে করি শুধুই বাংলাদেশি জনগণ কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ই এই বাংলা ভাষাতে কথা বলেন তাহলে ভুল হবে। বাংলাদেশ ছাড়াও আরো একটি স্বাধীন দেশের স্বীকৃত ভাষা বাংলা। কোন সেই দেশ যে দেশের মানুষ বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা করে নিয়েছে আর কেনই বা নিয়েছে?
দেশটির নাম সিয়েরা লিওন।

ছবিতে সিয়েরা লিওন
সিয়েরা লিওন পশ্চিম আফ্রিকার একটি দরিদ্র দেশ। যার সাংবিধানিক নাম সিয়েরা লিওন প্রজাতন্ত্র। ভূ-রাজনৈতিকভাবে সিয়েরা লিওনের উত্তর সীমান্তে গিনি, দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে লাইবেরিয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের দিকে আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থান। দেশটির বৃক্ষহীন তৃণভূমি অঞ্চল থেকে রেইনফরেস্ট অবধি বিচিত্র পরিবেবেশে গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু বিরাজ করে। সিয়েরা লিওনের মোট আয়তন ৭১ হাজার ৭৪০ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭ মিলিয়ন (২০১৫ জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুসারে)।

ছবিতে সিয়েরা লিওন
ছোট্ট এই দেশটির রাজধানীর নাম ফ্রিটাউন। শহরটি দেশের বৃহত্তম এবং অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে।

ছবিতে ফ্রিটাউন

ফ্রিটাউনের রাস্তা
বো সিয়েরা লিওনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এক লক্ষের বেশি জনসংখ্যাভূক্ত অন্যান্য শহরগুলো হল কেনেমা, ম্যাকেনি, কাইদু। সিয়েরা লিওন উত্তর, পূর্ব, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল– চারটি ভৌগলিক অঞ্চলে বিভক্ত সেগুলো, আবার ১৪টি জেলায় বিভক্ত।

ছবিতে কেনেমা
সিয়েরালিওন খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে হীরা এর অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি।

সিয়েরা লিওনের ডায়মন্ড
এছাড়াও রয়েছে অন্যতম পণ্য– টাইটানিয়াম, বক্সাইট, লোহা এবং রয়েছে অন্যতম প্রধান পণ্য সোনা। এছাড়াও রয়েছে রুটাইল এর পৃথিবীর বৃহত্তম মজুদের একটি অংশ।

ডায়মন্ড মাইনিং করছে সিয়েরালিওনিয়ানরা
এত প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও সিয়েরালিওনের ৭০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন।
সিয়েরা লিওন ১৯৬১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। সরকারের দুর্নীতি, বাইরের দেশের অবাধ হস্তক্ষেপে ও প্রাকৃতিক সম্পদের অব্যবস্থাপনার ফলে সিয়েরা লিওনে গৃহযুদ্ধ হয় (১৯৯১-২০০২) যার জন্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চলে। এ যুদ্ধে ৫ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়, দেশের অবকাঠামো প্রায় সব ধ্বংস করে, এবং দুই মিলিয়ন মানুষ প্রতিবেশি দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে বাস্তুহারা হয়।

সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী

সিয়েরা লিওন আর্মির দুই শিশুযোদ্ধা
এই গৃহযুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞই একদিন শান্তিতে রূপ নিতে পারার পথ ধরেই দেশটির রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলায় পরিণত হয়। সিয়েরা লিওনে প্রায় ১৬টি জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা ভাষা ও রীতিনীতি। দুটি বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতিগোষ্ঠী হল তেমনে ও মেন্দে। তেমনে জাতিগোষ্ঠীকে দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রাধান্য করতে দেখা যায়, যখন মেন্দেরা দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। যদিও দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে সরকারি প্রশাসন ও বিদ্যালয়সমূহে ইংরেজীতে কথা বলা হয়, তবুও দেশে এবং দেশের সকল ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিও ভাষা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত কথ্য ভাষা। বিশেষ করে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য এবং এক অপরের সাথে সামাজিক যোগাযোগে ক্রিও ভাষা ব্যবহার করে। এছাড়া ২০০২ সালে তৎকালীন সরকার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এই স্বীকৃতি এই অর্জন হঠাৎ করে হয়নি। এটা হয়েছিলো সে দেশের গৃহযুদ্ধ থামাতে এবং গৃহযুদ্ধের পর দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ।
১৯৯১ সালের পর থেকে সেখানে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যুদ্ধ প্রকট হতে থাকলে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নেয়। বাংলাদেশ এবং আরো ১২ টি দেশ শান্তি মিশনে যোগ দেয়। ভয়ানক পরিস্থিতির কারণে অনেক দেশ সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ তখন সেখানে খুব অল্প সময়ের নোটিশে আরো সেনা পাঠায়। বাংলাদেশি সেনারা একাধারে গেরিলা নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো পুনরুদ্ধার করতে থাকে, সংঘাত ও দাঙ্গা দমন করতে থাকে, শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কর্মসূচি চালাতে থাকে এবং বিভক্ত জাতিগুলোর মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্বক ব্যবস্থা নেয়।

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ আর্মি
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানে অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনীর মতন শুধু যুদ্ধ করে নয়, বরং মানবিক কাজ ও ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে নেয়। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশী সেনারা ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও ব্যবহার করতে থাকে, স্থানীয় লোকজনকে শেখাতে শুরু করে। বাংলাদেশি সেনাদের আন্তরিকতায় সাধারণ মানুষ বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করে আগ্রহের সঙ্গে। বাংলা ভাষার সাথে সাথে তারা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচিত হতে থাকে।
একসময় দেখা গেলো স্থানীয়রা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাঙালি নাচ ও গান পরিবেশন করছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সিয়েরালিওন সরকার বাংলা ভাষাকে সে দেশের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ তেজান কাব্বাহ বাংলাদেশ সেনাদলের নির্মিত একটি ৫৪ কিলোমিটার সড়ক উদ্বোধন কালে এই ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বাদে মানে এশিয়ার ভূমিসীমার বাইরে এই প্রথম কোন দেশে বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল।

বাংলাদেশ আর্মির সাথে স্মৃতিসৌধে সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ কাব্বাহ
ভৌগলিক বা সাংস্কৃতি উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সিয়েরা লিওন। কিন্তু এ দুই দেশের সম্পর্ক এতটাই গভীর ও আন্তরিক যে, এ দেশের ভাষাকে নিজেদের করে নিয়েছে আফ্রিকার দেশটি। ১৯৯১-২০০২ সাল পর্যন্ত দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছে গৃহযুদ্ধে অভিশাপে। সেই সময়টাতে সিয়েরা লিওনে শান্তি ফেরাতে বিপুল পরিমাণ শান্তি বাহিনী নিয়োগ করে জাতিসংঘ। তাদের বড় একটি অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ দেশের সেনারা সিয়েরা লিওনের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। দেশটিতে শান্তি ফেরাতে রেখেছেন ব্যাপক ভূমিকা। বিদ্রোহীদের দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের কার্যক্রম ছিল অনবদ্য।

শান্তিরক্ষা মিশনে লাল সবুজের পতাকা তলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
বাংলাদেশিরা যা করেছেন, তার জন্য সিয়েরা লিওনের সরকার কৃতজ্ঞ। সেই সাথে কৃতজ্ঞ সেখানের বিদ্রোহীরা। কোন সমস্যা হলেই সরকার বিদ্রোহীরা ছুটে যেতেন বাংলাদেশের সেনা ক্যাম্পে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানে এতই জনপ্রিয় হয় যে ২০০২ এর আগে পরে শান্তি ফিরে আসে দেশটিতে। প্রেসিডেন্ট আহমাদ তেজান কাব্বাহ কৃতজ্ঞতা জানাতে একটুও দেরি করলেন না। তিনি বাংলাদেশি সেনা সদস্যদের ভূমিকাকে চিরস্মরণীয় রাখতে বাংলা ভাষাকে দেশটির সরকারি ভাষার মর্যাদা দিলেন।
তাই আমরা যখন ফেব্রুয়ারিতে নিজ দেশে বাংলা ভাষাকে মর্যাদা জানাই, তখন সিয়েরা লিওনেও আমাদের মায়ের ভাষা সমমর্যাদা দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করে। গোটা বিশ্বজুড়ে যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালিত হয়, তখন সবাই মনে করেন, বাংলাদেশের মানুষ তাদের মায়ের ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। গোটা বিশ্বের সব দেশ ও মানুষের সঙ্গে তখন আমাদের এক অটুট বন্ধন স্থাপিত হয়।
(সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি নিয়ে গ্রামীনফোনের একটি টিভিসি আছে, চাইলে দেখতে পারেন।)
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অবদানকে আমাদের দেশ এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি জানায়নি। সেনাবাহিনীকে শুধু সামরিক দিক থেকে না ভেবে, সিয়েরা লিওনে সংষ্কৃতি ও ভাষার জন্য তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনন্য নজির হয়ে থাকবে। আমাদের বাংলাদেশের সম্মান ও ভাষার বিকাশে অবদানের জন্য অনেকে পুরস্কার পান সেখানে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবদানের জন্য তাদেরকেও সরকারী ভাবে পুরস্কার দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি।
সূত্র- ইন্টারনেট ও নিজে সংযোজিত
Leave a Reply