অনেকে হয়তো জানেননা আমাদের প্রাচীন বাংলা জাহাজ তৈরিতে ছিল বিখ্যাত। বাংলা থেকে তৈরিকৃত জাহাজ ছিল বিশ্বখ্যাত ও তা সবচেয়ে বেশী রপ্তানি হতো ইউরোপে।

সুলতানি আমল কে মূলত জাহাজ শিল্পের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তখন তুর্কী অটোম্যানদের কাছে বাংলা থেকে যুদ্ধজাহাজ রপ্তানি করা হতো। সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকদের সময়ে নিয়ম ছিল যুদ্ধজাহাজ গুলি কখনো অমুসলিমদের কাছে বিক্রি করা হতো না। কারণ তৎকালীন মুসলিম শাসকদের বিশ্বাস ছিল অমুসলমান কারো কাছে অস্ত্র বিক্রি করলে এতে করে মুসলমানদের ক্ষতি হতে পারে।

বাংলার সুলতানদের অনুমতি নিয়ে ও নিজের দায়িত্বে যুদ্ধজাহাজ ও কামানগুলি ছাড়পত্র দিতেন। এতে অটোম্যান সুলতানদের আবেদন ও অনুমতিপত্র লাগতো। একবার চিন্তা করেন প্রাচীন কালে মুসলিম শাসকগণ নিজের জাতির জন্য কতটুকু চিন্তা করতেন ও অস্ত্রগুলি যাতে মুসলিম বাদে বাইরের কারো হাতে না যায় এর জন্য কত নিয়ম চালু করে রেখেছিলেন। ইউরোপে মূলত বাণিজ্যিক জাহাজ বিক্রি হতো। বলতে গেলে সেই সময় ছিল শিল্প বিল্পব ঘটেছিল বাংলা ও ভারতে। এই অঞ্চলের অস্ত্র, জাহাজ গুলি ছিল বিশ্বখ্যাত।

এইসব জাহাজ বানানোর জন্য কাঠ ছাড়াও লাগতো লোহা, তামা, কাঁসা এবং দস্তার কাজ, যা করতো আমাদের দেশের কারিগরেরা। জাহাজের ডিজাইন করার কাজ করতেন তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ার রা। দস্তা মূলত চীন থেকে আমদানি করা হতো। তবে জাহাজ ও অস্ত্র শিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে স্থানীয়ভাবে বিশাল ষ্টীল ও ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠেছিল।

বাংলা থেকে যে জাহাজগুলি তৈরি হতো তা ছিল মানের দিক দিয়ে ইউরোপ থেকে অনেক উন্নত। কারণ বাংলার জাহাজ শিল্পের তথ্যভাণ্ডারের পঞ্জিকা বলছে ১৬৮১-১৭৩৯ এর মধ্যে মাত্র ৬০ জাহাজ ২৫ বছর চালিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে। এতে বুঝা যায় বাংলার জাহাজগুলির গড় বয়স ছিল ২৫ বছর, সে তুলনায় লিভারপুর বা ব্রিস্টলের, গ্রানাডা ও রুশ জাহাজের বয়স ছিল এগার বছর আর টেমসে বারো বছর। সে সময়ের লেখায় বাংলার জাহাজের এইগুণমানটা দেখলেই বুঝা যায় কতটুকু তফাৎ ছিল প্রযুক্তিতে।

 

বাংলার জাহাজ শিল্প ধ্বংসঃ

ঔপনিবেশিক আমলের প্রায় কয়েকশত বছর আগে বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিজ ইউনিট গড়ে উঠে। ব্রিটিশরা আসার পরে যখন দেখল উক্ত এলাকায় শিল্প অনেক উন্নত ফলে ব্রিটিশ ও ইউরোপ থেকে তাঁরা অনেক কমদামে জাহাজ তৈরি করতো। উৎপাদনের খরচের দিক থেকেও বাংলার নৌ-শিল্প তুলনামূলক সস্তা ছিল। ১৭৮১-৯১ সালে টন পিছু উৎপাদন ব্যয় ছিল ১৯০ টাকা, ১৮০০-১০ সালে ছিল ২৫০টাকা, ১৮১১-১৬ সালে ছিল ৩০৫ টাকা এবং ১৮১৭-২০ এর সময় কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় সেটিও কমে হয় ২৫০ টাকা। এই সময়ে ব্রিটিশ শিল্প কোনভাবেই বাংলার খরচের আশেপাশে দাঁড়াতে পারেনি। প্রথম দশকের বাংলার ২৫০টাকার তুলনায় ব্রিটেনে খরচ ছিল ৫১৫ টাকা, তৃতীয় শতকের ১৩৫ টাকার তুলনায় ব্রিটেনের খরচ ছিল ২৪০ টাকা।

 

৬.১০ তালিকায় লন্ডনে তৈরি লর্ড নেলসন আর বাংলায় তৈরি চারটি সেই শ্রেণীর জাহাজের খরচের তুলনা করা হয়েছে,

বাংলায় তৈরি ৮০০ টনের জাহাজের খরচ ছিল ৩৪৭০.৭৬ টাকা, লন্ডনে ছিল ৭৬৮৯.৫০ টাকা, ৫৫% কম। বাংলার জাহাজের ব্যবহারের জন্য ক্ষয়(wear and tear) ও লন্ডনের তুলনায় কম পাঁচটা সমুদ্র যাত্রার গড় ক্ষয় ছিল ৫৬৯৪ পাউন্ড, সেখানে লন্ডনের ছিল ১১৫৭২ পাউন্ড। একটি জাহাজের বাংলায় সারাবার(মেরামতের) খরচও তুলনামূলকভাবে কম, ৩৭৬০ বনাম ৮৩২০ টাকা।

(সূত্র Indian Steam Committee 12 October 1838 ও লয়েডের তথ্যভাণ্ডারে (Lloyd’s register) – বাংলার তৈরি প্রত্যেকটা জাহাজ Al মার্কা পেয়েছে।)

ফলে তাঁরা দেখল এতে করে নিজেদের উপমহাদেশের শাসন মোটামুটি নিলেও তা যে কোন সময় হাত ছাড়া হতে পারে কারণ তখন সারা উপমহাদেশ জুড়ে চলছিল বিশাল বিদ্রোহ।

তাছাড়া এমনিতেই ইউরোপে শিল্পগুলি বিশেষ করে ভারী শিল্প প্রতিযোগিতায় উপমহাদেশের সাথে টিকতে পারছেনা। অনেক কমদামে ইউরোপ থেকে ভালমানের পণ্য ডেলিভারি দিত বাংলা। তাছাড়া তখন চলছিলো ইউরোপ জুড়ে শিল্প বিপ্লবের আসন্ন একটা সময়, তারা চিন্তা করল উক্ত এলাকার মানুষের যে দক্ষতা তাতে করে তারাও উক্ত এলাকাতে শিল্প বিপ্লবের আশঙ্কা করেছিল। তাছাড়া তখন তারা ভারতীয় নবাব ও রাজাদের শক্ত প্রতিদন্ধিতার মুখে পরছিল ফলে হেরে গেলে উক্ত এলাকা অদূর ভবিষ্যতে তাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এই আশঙ্কায় নানা ভাবে বাঁধা দেওয়া ও ধ্বংস করে দিতে থাকল। অনেক কারিগর ও ইঞ্জিনিয়ারকে হত্যা করা হয়।

প্রতিনিয়ত যুদ্ধ বাঁধা দানের ফলে বলতে গেলে ১৮২০ সালের দিকে পুরাপুরি ধ্বংস হয়ে যায় আমাদের সমৃদ্ধ জাহাজ শিল্প। ঠিক একই পরিণতি বরণ করে আমাদের সমৃদ্ধ কাপড় শিল্পকেও।

সূত্র- ইন্টারনেট ও নিজে সংযোজিত

Facebook Comments

comments