রকেট বলতেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে একটি চোঙাকৃতির যান যার পেছন দিয়ে অসম্ভব বেগে ঘন ধোঁয়া বের হচ্ছে ও যানটি প্রচণ্ড বেগে উপরে উঠছে।

সচারাচর আমরা রকেট বলতে মহাকাশ যান বুঝে থাকি যদিও রকেটের ব্যবহার অনেক। তবে মহাকাশে যেতে ‘মুক্তি বেগ‘ অর্জন করতে হয় যা রকেট প্রযুক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। মুক্তি বেগ হচ্ছে অভিকর্ষ বল চ্ছিন্ন করে স্পেসে যাওয়ার ন্যূনতম বেগ যা ঘন্টায় ৩৩ হাজার কিলোমিটার।

মানুষের তৈরী মহাকাশে যাওয়া প্রথম বস্তু হলো Bumper WAC যা জার্মানদের তৈরী। ১৯৪৯ সালে এই রকেট স্পেসে প্রবেশ করে ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নেয়। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩৯৩ কিলোমিটার উচ্চতায় ওঠে। এটি একটি V-2 রকেট চালিত যান ছিলো যার ওয়্যারহেড হিসেবে JPL WAC Corporal মিসাইল বসানো হয়।

থার্ড রাইখের বিজ্ঞানী Wernher von Braun এর নের্তৃত্বে V-2 রকেট তৈরী হয় যার ব্যাপারে বিশদ পোস্ট পূর্বে করা হয়েছে। নাৎসী জার্মানীর পরাজয় হলে বিজ্ঞানী Wernher von Braun তার টিম সহ ইউএস’র নিকট আত্মসমর্পন করেন ও রকেট সাইন্সে গবেষণা করে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। আধুনিক বিজ্ঞানের জনক ছিলেন মূলত থার্ড রাইখের বিজ্ঞানীরা। ফুয়েরার এডলফ হিটলার সুদক্ষ সামরিক অফিসার ছাড়াও বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানীর সুচারু সন্নিবেশ করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তারা নাৎসী জার্মানীকে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান।

কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই নতুন পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মান বিজ্ঞানীদের যে যেভাবে পারে ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। তখন তারা নতুন সরকারের অধীনে কাজ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘স্পুটনিক-১’ মহাশূণ্যে সফলভাবে প্রেরণ করে যা ছিলো মানবজাতির প্রথম সফল কৃত্রিম স্যাটেলাইট যা R-7 রকেট দিয়ে পাঠানো হয়।

এরই জবাব হিসেবে আমেরিকা ১৯৬৯ সালের ১৬ই জুলাই এপোলো-১১ (Apollo 11) মিশন প্রেরণ করে যার লুনার মডিউল ‘ঈগল‘ ২০শে জুলাই চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে এবং মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং মানবজাতির প্রথম সদস্য যিনি চাঁদের বুকে পা রাখেন। এই নভোযান মহাশূণ্যে নিয়ে যায় Saturn V SA-506 নামক রকেট।

মহাকাশ যাত্রায় প্রথমে রকেট ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে খরচ কমানোর জন্য স্পেশ শাটল ব্যবহার শুরু করে।

স্পেস শাটল মূলত একটি আলাদা স্পেস ক্রাফট যা একাধিক রকেটের সাথে যুক্ত থাকে। মহাশূন্যে যেতে যে পরিমাণ জ্বালানীর প্রয়োজন তা ধরে রাখতে বিশাল আকৃতির মহাকাশ যান দরকার। আবার এই বিশাল যান শুধুমাত্র জ্বালানীর জন্য অপারেট করাও ব্যয়বহুল। তাই এমন একটি ব্যবস্থা নেয়া হয় যেন মূল স্পেস ক্রাফট একটা দূরত্ব পাড়ি দেবার পর রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সর্বপ্রথম স্পেস শাটল আনে সোভিয়েত ইউনিয়ন যার নাম ‘সয়ুজ’ স্পেসক্রাফট।

এটি সর্বপ্রথম ১৯৬৬ সালে মানববিহীন ও ১৯৬৭ সালে মনুষ্যবাহী হয়ে মহাকাশে যাত্রা করে।

অপরদিকে আমেরিকাও সোভিয়েতদের পথ অনুসরণ করে। তারা ১৯৮১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন নামে ৫টি স্পেস শাটল স্পেসে পাঠায় যার মাঝে ২টি অপারেশন চলাকালীন ধ্বংস হয়ে যায়। এই স্পেস শাটলগুলিও মহাশূণ্যে নিতে বিভিন্ন মডেলের রকেট ব্যবহার করা হয়। সোভিয়েতরা সয়ূজ স্পেস শাটলে একটি রকেট ও চারটি বুস্টার ও আমেরিকানরা দুইটি রকেট ও দুইটি বুস্টার ব্যবহার করে।

সোভিয়েতরা R-7 রকেট ও আমেরিকানরা RS-25 রকেট ব্যবহার করে। একাধিক স্টেজ পার হয়ে মূল স্পেস ক্রাফট স্পেসে যায় এবং এর আগে আলগা রকেট/বুস্টার ডিসকানেক্টেড হয়ে যায়। এই রকেটগুলো সাধারণত একবারই ব্যবহার করা যেত। তবে কিছুদিন আগে Tesla এর প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্ক SpaceX প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেখিয়েছেন একটি রকেট ইঞ্জিন একাধিকবার ব্যবহার করা যায়।

প্রথমেই যা বলছিলাম। রকেট শুধুমাত্র মহাকাশ যান হিসেবেই ব্যবহার করা হয় না। বিয়ে-শাদী বা কোন আনন্দ-উৎসবে আমরা যে হাউই বা আতশবাজি যা Fire Crackers নামে পরিচিত সেটাও রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে আকাশে উড়ানো হয়। একই কাজ সাগরে বা মরুভূমিতে বিপদে পড়লে নির্দিষ্ট রঙের আতশবাজি ছোড়া হতো সাহায্যের আশায় যেন দূর থেকে কেউ দেখলে এগিয়ে আসতে পারে।

যুদ্ধকালীন সময়ে সেনাবাহিনী রাত্রিকালীন সময়ে অপারেশন চালালে আশ-পাশ দেখার জন্য ফ্লেয়ার্স ছুড়ে মারে আকাশে যা বিস্ফোরিত চারদিক আলোয় ভরিয়ে দেয়। সেটাও করা হয় রকেটের মাধ্যমে। আর যুদ্ধের কথা যেহেতু আসলোই তখন আরপিজি (RPG= Rocket Propelled Grenade) এর কথা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। যুদ্ধের রাজা নামে পরিচিত ট্যাঙ্কের যম।

তাছাড়া MANPAD যা কাঁধ থেকে ছোড়া যায় এমন মিসাইল বা এয়ারক্রাফট বিধ্বংসী ‘স্ট্রিংগার মিসাইল’ অথবা অটোক্যাট বা ব্রহ্মমস নামক মিসাইলগুলোও রকেট প্রযুক্তির ব্যবহার। রাশিয়ার তৈরী কাটিউসা রকেট যার রেঞ্জ ১০-১০০ কিমি এবং এরই ডিজাইনে তৈরী ফিলিস্তিনের হামাস বাহিনীর ‘কাশাম-৪‘ রকেট যার রেঞ্জ ১৬-২৫ কিলোমিটার। তাছাড়া ক্ষেপণাস্ত্রের উদাহরণ স্বরূপ ইরাকের স্কাড বা আমেরিকার প্যাট্রিয়ট অথবা ভারতের অগ্নি মিসাইল রকেট প্রযুক্তিরই আরেক নাম।

রকেটের জন্ম চীন দেশে যারা বারুদ আবিষ্কার করেছিলো তাদের হাত ধরেই ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। আর উৎকর্ষতা ভারতের টিপু সুলতানের হাত ধরে যার নাম রকেটের প্যাটেন্টে রয়েছে। সুপারসনিক প্রযুক্তি লাভ করে জার্মানদের হাত ধরে ও সফলভাবে মহাকাশে যায় সোভিয়েতদের মাধ্যমে। রকেটের জন্ম, ইতিহাস ও উন্নয়ন নিয়ে আরেকদিন লিখবো।

 

Rocket

মহাকাশে প্রেরিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য রকেট

রকেট প্রযুক্তি ওপর নির্মিত ব্যালিস্টিক মিসাইল

Fireworks Sydney 2018

রকেট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্ণিল ফায়ারওয়ার্কস, সিডনী

London Fireworks

রকেট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্ণিল ফায়ারওয়ার্কস, লন্ডন

Fireworks From a Australian Naval Ship

অস্ট্রেলিয়ান নেভাল শীপ থেকে ফায়ারওয়ার্কস এর বর্ণিল দৃশ্য

বিখ্যাত জাহাজ টাইটানিক থেকে প্রজ্জলিত ফায়ারওয়ার্কস এর দৃশ্য

 

লেখায়ঃ নাজমুস সাকিব
সংগ্রহেঃ শিহরণ

Facebook Comments

comments