১৯৭৬ সালের ২৭ জুলাই। এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট ১৩৯ (যেটি ছিল Airbus A 300) ২৪৮ জন যাত্রী নিয়ে গ্রীসের রাজধানী এথেন্স থেকে ইসরাইলের রাজধানী তেল আবিবে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের ভিতর বিমানটি পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্যা লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের ২ জন আর জার্মান রেভলুসনারি সেলের ২ জন সদস্য ছিনতাই করে।

পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্যা লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইনের ফ্লাগ

এয়ার ফ্রান্সের এয়ার বাস এ৩০০
বিমানটিকে আফ্রিকার দিকে যেতে বাধ্য করা হয়। প্রথমে লিবিয়ার বেনগাজিতে বিমানটি অবতরণ করে। সেখানে ৭ ঘণ্টা রিফুয়েলিং এর জন্য বিরতির পর আবার রওনা দেয় বিমানটি। অবশেষে উগান্ডার এন্তেব্বে বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করে। উগান্ডার সেসময়ের স্বৈরশাসক ছিলেন ইদি আমিন।

ছবিতে জেনারেল ইদি আমিন
তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ছিলেন। জেনারেল ইদি বিমানের আশেপাশে সশস্ত্র সৈন্য নিয়োজিত করলেন। আর জিম্মিদের রাখা হল পরিত্যক্ত টার্মিনালে। সেখানে আরও ৩ জন ছিনতাইকারী এই দলের সাথে যুক্ত হল।

জিম্মিদের সাথে ইদি আমিনের কথোপকথন
পরের কয়েকদিন জিম্মিদের উদ্ধারে সকল আলোচনা ব্যর্থ হল। ছিনতাইকারীরা ৫৩ আরব এবং জার্মান গেরিলার মুক্তি দাবি করল। নয়তো তারা সকল জিম্মিকে হত্যা করবে।
অবশেষে ৮৫ জন ইসরাইলি নাগরিক ও ইহুদী এবং ২০ জন ক্রু ছাড়া সবাইকে ছেড়ে দেয়া হল। বিমানের ক্যাপ্টেন এবং ক্রুরা থেকে গেলেন স্বইচ্ছাতে কারন যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের উপর বর্তায়।
১ জুলাই ইসরাইলি সরকার ছিনতাইকারীদের সাথে আলোচনায় রাজি হলেন। তবে ছিনতাইকারীরা ৪ জুলাই পর্যন্ত সময় দিলেন নয়তো তারা একে একে সকল জিম্মিকে হত্যা করবেন।
উদ্বিগ্ন আত্মীয়রা তেল আবিবে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনের বাসভবন আক্রমণ করলেন। কিন্তু ইসরাইলি সরকার আগের মতই উদাসীন ছিল।
কিন্তু গোপনে ইসরাইলি সরকার এন্তেব্বে বিমানবন্দরে কমান্ডো অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনী ইসরাইলি একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে যারা ষাটের দশকে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভবন তৈরি করেছিল। তারা ছাড়া পাওয়া বিভিন্ন জিম্মিদের কাজ থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করে।

ইজরাইলি কমান্ডোদের করা এনতেব্বে টার্মিনাল এরিয়ার প্লান ম্যাপ
তারপর ৪ জুলাই সন্ধ্যাবেলা শুরু হল অপারেশন থাণ্ডার বোল্ট।
৪ টি সি ১৩০ হারকিউলিস পরিবহন বিমান যাতে ছিল ৩২ জন কমান্ডো, ৫২ জন প্যারাট্রুপার এবং বিভিন্ন যানবাহন এন্তেব্বে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেয়।
তারা সারম আল শেইখ এবং লোহিত সাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট লেভেলের অনেক নিচ দিয়ে উড়ে যায় সৌদি আরব, মিসর এবং সুদানের বিমানবাহিনীর রাডার ফাঁকি দিতে। ২ টি বোয়িং ৭০৭ হারকিউলিসগুলোকে অনুসরণ করে। একটি নাইরোবি বিমানবন্দরে(কেনিয়ার বিমানবন্দর) অবতরণ করে, অন্যটি কমান্ডো অভিযানের সময় এন্তেব্বে বিমানবন্দরের উপর চক্কর দেয়। এই বিমানে ছিলেন অভিযানের নেতা জেকুতিয়েল আদম।
প্রথম হারকিউলিস ভিক্টোরিয়া হ্রদের উপর দিয়ে আস্তে আস্তে উচ্চতা কমিয়ে অবতরন করল এন্তেব্বে বিমানবন্দরে। এটা সাধারণ বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের মত নামলো। কমান্ডোরা দ্রুত নতুন টার্মিনাল ভবন এবং জ্বালানিখানার দখল নিল। প্লেন থেকে বেরিয়ে এল দুটি ল্যান্ড রোভার যারা একটি কালো মার্সিডিজকে এসকোর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল।
এর ভিতর ছিল ইসরাইলি কমান্ডোরা। তিনটি যান ৪০ কিমি/ঘণ্টা বেগে এগিয়ে যেতে লাগলো যাতে মনে হয় এটা প্রেসিডেন্ট আমিনের অফিশিয়াল একটা সফর। পরিত্যক্ত টার্মিনালের সামনে তারা দুজন উগান্ডান সেনার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল। তাদের সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের সাহায্যে হত্যা করা হল। এটা সারপ্রাইস আক্রমনের সুযোগ নষ্ট করে দিতে পারে এই ভয়ে কমান্ডোরা দ্রুত পুরাতন টার্মিনালের দিকে এগিয়ে গেল। এটি রানওয়ের সাথে লাগানো ছিল। টার্মিনালের ভিতর ঢুকে কমান্ডোরা ছিনতাইকারীদের উপর প্রকাশ্যে গুলি চালাল। ৪ জন ছিনতাইকারী জিম্মিদের পাহারা দিচ্ছিল আর ৩ জন ভিআইপি টার্মিনালে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এক মিনিটের ভিতর তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। ৪৫ জন উগান্ডান সেনা ও নিহত হলো কমান্ডোদের সাথে যুদ্ধে। দুর্ভাগ্যক্রমে ৩ জন জিম্মি ক্রসফায়ারে নিহত হয়। এদের ভিতর একজন ১৯ বছর বয়স্ক ফরাসি নাগরিক জীন মায়মউনি কমান্ডোদের আনন্দে জড়িয়ে ধরতে গেলে তাকে ছিনতাইকারী ভেবে হত্যা করে কমান্ডোরা।
অপারেশনের সময় হিব্রু আর ইংরেজিতে কমান্ডোরা চিৎকার করে বলে “Stay down! Stay down! We are Israeli soldiers”
কমান্ডোদের ভিতর একমাত্র নিহত হন কমান্ডো দলের নেতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন নেতানিয়াহু (ইসরাইলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুয়ের ভাই) যাতে এক উগান্ডান সৈন্য কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করে। যে এক উগান্ডান সৈন্য গুলি ছুঁড়েছিল তাকে পাল্টা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়।

কর্নেল জোনাথন নেতানিয়াহু
এদিকে প্রথম হারকিউলিস অবতরণের ৭ মিনিট পর আরও ২টি হারকিউলিস আছে। রানওয়ের লাইট অফ থাকলেও তারা বিকনের সিগন্যাল ধরে ল্যান্ড করে। এ বিমানগুলোতে ছিল ৪ টি সোভিয়েত আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ার উগান্ডার সেনাবাহিনীর পাল্টা হামলা প্রতিরোধের জন্য। ২ টি আর্মড পারসোনাল ক্যারিয়ার এগিয়ে গেল বিমানবন্দরের উত্তরে যেখানে ১১ টি উগান্ডান মিগ ১৭ ছিল।
নিমিষেই ইসরাইলি এপিসির গোলার আঘাতে মিগ-১৭ গুলো ধ্বংস হয়ে গেল।
চতুর্থ হারকিউলিস অবতরণ করে টার্মিনাল ভবনের সামনে এল। জিম্মি আর কমান্ডোরা এর ভিতর ঢুকে গেল। পুরো অভিযান ৫৩ মিনিট স্থায়ী হয়। ৪ টি হারকিউলিস দ্রুত উগান্ডার আকাশসীমা ত্যাগ করে।
পরের দিন কমান্ডোরা মুক্ত জিম্মিদের নিয়ে ইসরাইলে ফিরে আসে।

তেল আবিবে ফিরে যাবার পর উদ্ধারকৃত জিম্মিদের উচ্ছাস
পুরো ইসরাইল জুড়ে আনন্দ উৎযাপন হয়। কমান্ডোদের রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়। ইসরাইলি সরকার নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন নেতানিয়াহুর নামে অপারেশনের নাম দেয় অপারেশন জোনাথন।
এদিকে ডোরা ব্লক নামক এক ৭৫ বছরের বৃদ্ধা জিম্মি ছিলেন। কমান্ডো অভিযানের পূর্বে অসুস্থ হওয়ায় তাকে উগান্ডার একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। কমান্ডো অভিযানের পর ইদি আমিনের নির্দেশে তাকে উগান্ডার সেনারা হত্যা করে। এছাড়া ইসরাইলকে কেনিয়া সহায়তা করায় কাম্পালাতে শত শত কেনিয়ান কে হত্যা করা হয়।
নিঃসন্দেহে অপারেশন থাণ্ডারবোল্ট ছিল একটি অন্যতম সেরা কমান্ডো অভিযান।
Leave a Reply