জার্মানিতে নাৎসিরা ফোর্থ রাইট গড়ে তুলার এইকাজটা করতে গিয়েও করতে পারেনি Operation Safe Heaven এর কারণে। নাৎসিদের ভবিষ্যৎ প্ল্যানগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে বেশ খানিকটা সক্ষম হয়েছিলো পশ্চিমারা)

 

নাৎসি বাহিনী রাইশ ব্যাংকের ভল্টের সোনার একটা অংশ ব্যাভেরিয়াতে ট্রাকে করে নিয়ে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে রেখেছিলো। এসব পরে মিত্রে বাহিনী গিয়ে উদ্ধার করে।

এই লুকানোর দায়িত্বে নিয়োজিত একজন Nazi কর্নেল Freidrich Josef Rauch মার্কিনীদের সাথে আতাত করে লুকিয়ে থাকা সোনার খোঁজ দেয়। সেই সোনা মাটি খুড়ে তুলতে তিন সপ্তাহ লেগেছিলো। (এটা কিন্তু লুকানো সোনার একটা অংশ)

রাইশ ব্যাংকের বিশাল স্বর্ণ ভান্ডারের এক বিশাল অংশ তখন সুইজারল্যান্ডের অজানা কোনো আকাউন্টে। নুরেমবার্গে বড়বড় নাৎসি নেতার বিচার ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হলেও তাদের ব্যক্তিগত অর্থ সম্পদ নিরাপদেই ছিলো সুইস ব্যাংকে।

তো যাই হোক, আবার সুইস ব্যাংকে ফেরা যাক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকা ও ব্রিটেন আলোচনায় বসে সুইস সরকারের সাথে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া জার্মানি আবার নতুন করে গড়ে তোলার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। সুইস সরকার বলে, রাইশ ব্যাংকের ৪০০ মিলিয়ন ডলার মুল্যের স্বর্ণ মজুদ আছে তাদের কাছে। (এটা ছিলো আসল হিসাবের অনেক অনেক কম) (সুইস সিক্রেসি বলে কথা !)

৬০ মিলিয়ন ডলার সুইজারল্যান্ড তুলে দিতে রাজি হয় মিত্র বাহিনীর হাতে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ ইহুদী হত্যা করা হয়। এদের অনেকের টাকা পয়সা জমা ছিলো সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বেঁচে থাকা ইহুদীরা তাদের মৃত আত্মীয় স্বজনের জমানো টাকা তুলতে চাইলে বাধে বিপত্তি। অনেক ইহুদি তাদের উত্তরাধিকারসুত্রে রেখে যাওয়া ন্যায্য সম্পদ উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। সুইস সরকার ইচ্ছাকৃত নানান গরমিল দেখাতে শুরু করে। তারা মৃত স্বজনের Death Certificate চায়। এটা ছিলো এক চুড়ান্ত রসিকতা।

কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিহত মানুষদের Death Certificate কিভাবে থাকবে ? !!!

(ওই যে, উপরে বলেছিলো, বেশি সিক্রেসি, কিন্তু এর ঝামেলাও আছে। আমাদের বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের ১২ বিলিয়ন ডলারের অর্থ সুইস ব্যাংকে আটকে আছে এখন। কেন আটকে গেছে, সেটা জানা যায় নি। কিন্তু সুইস ব্যাংকের অতিরিক্ত সিক্রেসি আর নানান জটিল নিয়ম কানুনের কিছু ঘাপলা তো আছেই। মুসা বিন শমসের বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য চেয়েছে তার অর্থ ফিরে পেতে)

 

সুইস সরকার এই কঠিন ব্যাংকিং সিক্রেসি আইন করেছিলো কিন্তু ১৯৩০ সালের দিকে। উদ্দেশ্য ছিলো সম্ভাব্য নাৎসি আগ্রাসনে ইহুদীরা যাতে তাদের সম্পদ নিরাপদে রাখতে পারে, সেটা। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সেই একই সিক্রেসি আইনের বলে এবার তারা ইহুদিদের জমিয়ে রাখা সম্পদ ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করতে শুরু করে।

প্রায় ৫০ বছর ধরে হাজার হাজার ইহুদীরা সুইস ব্যাংক থেকে তাদের অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই সময় ইহুদীরা সমগ্র বিশ্বে, বিশেষ করে মার্কিন মুল্লুকে অনেক প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

ফলাফল, এবার সুইস ব্যাংকের হিপোক্রেসি আর জারিজুরির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে আমেরিকার ক্ষমতাধর ইহুদীরা। Edgar Bronfman ছিলেন সাবেক World Jewish Congress এর প্রেসিডেন্ট। তিনি দীর্ঘদিন সুইস ব্যাংকের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিলেন। ১৯৯৫ সালে Edgar Bronfman সুইজারল্যান্ডে গিয়ে নেগোসিয়েশন করেন। ফলাফল, ৩২ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে সুইস ব্যাংক বাধ্য হয় শ’খানেক ইহুদি পরিবারের কাছে। কিন্তু একটা ছিলো ছোট একটা অংশমাত্র।

ফলাফল, ক্ষিপ্ত Edgar Bronfman আমেরিকা ফিরে এসে মার্কিন সিনেটের ব্যাংকিং কমিটিকে দিয়ে wall Street এর সুইস ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।

সালটা ১৯৯৬।

ভীষণ বিপদে পড়ে যায় সুইজারল্যান্ড। ১৯৯৭ সালে মার্কিন সিনেট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্লাসিফাইড তথ্য জনগনের সামনে প্রকাশ করে। তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর সাথে সুইজারল্যান্ডের লেনদেনের তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়।

সুইসব্যাংকের লোকদেখানো নিউট্রালিটিকে জনসম্মুখে তুলে ধরতে থাকে। ফলে ইমেজ সঙ্কটে পড়ে সুইজারল্যান্ড। নাৎসি কলাবোরেটর হিসেবে ট্যাগ খাওয়াটা সুইজারল্যান্ডের জন্য হবে সর্বনাশ। মার্কিন সিনেট হিসাব দেখায়, ৩৮০ টি ট্রাক লোডেড হয়ে জার্মান থেকে স্বর্ণ গিয়েছিলো সুইজারল্যান্ডে। জি হা, ৩৮০ টি ট্রাক !

 

সোনা যে কেবল রাইশ ব্যাংকের ভল্ট, বা বিভিন্ন লুটপাট করা দেশের ব্যাংক ভল্ট থেকে এসেছিলো, তায় নয়, ইহদিদের বাড়ি থেকে লুটকরা সোনাদানা গলিয়েও সোনার বার বানিয়ে চালান করে দেয়া হয়েছিলো। সেই সময় বুড়োরা দাঁত বাধাতো সোনা দিতে। সেইসময় এটা ছিলো আভিজাত্যের ব্যাপার। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মানুষের বাধানো সোনার দাঁত খুলে খুলে গলিয়ে সোনার বার বানানো হয়েছিলো।

এসব তথ্য প্রকাশের পর সুইস ব্যাংকিং ইন্ড্রাস্টির বারোটা বেজে যায়। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন এবার সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে। সুইস ব্যাংক এবার ৩০ বিলিয়ন ডলার পূর্ব ইউরোপে বসবাসরত ইহুদিদের ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু এতেও আমেরিকা সন্তুষ্ট নয়।

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে ৪১ টি দেশ আলোচনায় বসে সুইজারল্যান্ডের সাথে। সুইজারল্যান্ড রাজি হয় সব গচ্ছিত সম্পদ ফিরিয়ে দিতে। ৫ টন স্বর্ণ ফিরিয়ে দেয়া হয় পোলান্ডকে। নাৎসি সোনার বারের রাসায়নিক বিশ্লেষণ শুরু হয়। বেশকিছু সোনার বারে ছিলো উচ্চ লেভেলের মারকারির উপস্থিতি। অর্থাৎ এগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মানুষের খুলে নেয়া বাধানো দাঁত গলিয়ে বানানো হয়েছিলো।

১৯৯৮ সালে মার্কিন সরকার সফল হয়। সুইস ব্যাংক তাদের কাছে গচ্ছিতো ইহুদিদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে শুরু করে।

তবে এখানে আসে আরেকটা টুইস্ট। ৪ বিলিয়ন ডলার মুল্যের সোনার হিসাব আবার লাপাত্তা। ইন্টারেন্সটিং বিষয় হল, আমেরিকা নিজেই নাৎসিদের সোনার একটা অংশ গায়েব করেছে। হজম করেছে। এই অবৈধ স্বর্ণ দিয়েই প্রথমে OSS এবং পরে CIA এর covert operation এর funding দিতো সাধু আমেরিকা। সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্নায়ু যুদ্ধে যেমন আমেরিকা নাৎসি বিজ্ঞানীদের ঠিকই ব্যবহার করেছে, ঠিক একইভাবে নাৎসিদের চুরি করা অর্থ সোনাদানাও নিজেরা ব্যবহার করেছে গোপনে।

এবার নিশ্চয় বুঝতে পারতেছেন, কেন আমেরিকা দীর্ঘ ৫০ বছর (অর্থাৎ যতদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিলো) ততদিন সুইস ব্যাংকের গায়ে হাতও দেয় নি। সবই রাজনীতি।

 

এই হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সুইস ব্যাংকের ভুমিকা।

আজও আমরা শুনি, দেশের অমুক ব্যবসায়ী, তমুক রাজনীতিবিদ, অমুক মাফিয়া ডনের টাকা পয়সা সব সুইস ব্যাংকে। অর্থাৎ সমগ্র ব্যাপারস্যাপার সম্পর্কে আমাদের আইডিয়া কম হলেও এটা আমরা বুঝি, ক্ষমতাধর কেউ বিশাল অংকের টাকা লুকিয়ে রাখতে আজও সুইস ব্যাংক ব্যবহার করে। সুইস ব্যাংক বলতে আসলে সুইজারল্যান্ডের একটা ব্যাংক নয়, বেশকিছু ব্যাংককে বোঝানো হয়। যেমন, UBS, Credit Swiss, Julius Bar ইত্যাদি। সবচেয়ে নামকরা UBS। সুইজারল্যান্ডের সব ব্যাংকই সুইস সিক্রেসি এক্ট এর আওতায় পড়ে।

কিছুদিন আগে Wikileaks এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আস্যাঞ্জ বলেছিলেন, সুইস ব্যাংকে থাকা টাকার একটা বড় অংশ আসে এশিয়ার ৩য় বিশ্বের মত দেশ থেকে।

ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ এবং সচিবেরা তাদের লুটপাটের টাকা বা কালো টাকা নিরাপদে সুইস ব্যাংকে গোপন করে।

মিশরের সাবেক ডিক্টেটর হোসনী মোবাররকের পতনের পর সুইস ব্যাংক থেকে তার নামে রাখা ১৭০ বিলিয়ন ডলার ফিরিয়ে এনেছিল তৎকালীন মুরসি সরকার। তিউনিশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট তিনি ছিলেন সেই দেশের জাতিক জনকের ছেলে তিনি অনেক ক্লিন ইমেজের পরিচিত ছিলেন।

শেষে দেখা গেল তিনি গোপনে রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যাবার আগে ৬০ বিলিয়ন ও তাঁর নিজের নামে ২৭ বিলিয়ন ডলার সুইজ ব্যাংকে সরিয়েছেন !

 

জনবিক্ষোভে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পালিয়ে গেলে সব হিসাব শনাক্ত করে এই অর্থ ফিরিয়ে আনা হয়। রাষ্ট্রের অর্থ এমনভাবে চুরি করার দায়ে ও গোপন একাউন্ডে টাকা জমানোর দায়ে বেন আলীকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য তিনি এখন পালিয়ে আমেরিকা থাকেন। অর্থাৎ শুনে বুঝতে পারছেন বিল গেইটসের সম্পদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।

এই রকম বহুত আছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরব শেখ থেকে মেক্সিকো, কলোম্বিয়া, ইতালি ও রাশিয়ার মাফিয়া ডনেরা। এদের টাকার গন্তব্য সেই সুইজারল্যান্ড।

 

 

সূত্র-ইন্টারনেট ও নিজে সংযোজিত

Facebook Comments

comments