ভিন্নদেশ দখল করা হিটলারের জন্য বেশ লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হতে শুরু করে। একটা দেশ দখল করো, এরপর সেইদেশটিকে নিজ সম্রাজ্যে একীভূত করো। এবং সেই দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক লিকুইডেট করো। সোজা হিসাব। সরল লুটপাট।

১৯৩৯ সালের শুরু থেকেই ইউরোপের আকাশে যুদ্ধের আভাস ভাসতে শুরু করে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর জার্মানির ভেতর করা “মলোটভ-রিবেনটপ প্যাক্ট” একরকম যুদ্ধের দোয়ার খুলে দেয়। এটা মুলত ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়ন আর জার্মানির ভেতর ইউরোপ নিয়ে ভাগাভাগির প্রথম পর্বের হিসাব কিতাব।

 

তো যাই হোক, হিটলার পোলান্ড আক্রমন করার মাধ্যমে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, জার্মানিকে বারবার সতর্ক করেছিলো পোলান্ড আক্রমনের ব্যাপারে। কিন্তু হিটলার সেই হুমকি উপেক্ষা করে পোলান্ড আক্রমন করলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটেন এবং ফ্রান্স অফিসিয়ালি জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

হিটলার পোলান্ড দখলের পর প্রথম ধাক্কা খায়। পোলান্ডের রাজধানী ওয়ার্সা (Warsaw) এর সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে পোলিশরা সোনা সরিয়ে রোমানিয়া আর তুরস্ক ঘুরে পাঠিয়ে দিয়েছে ফ্রান্সে। অর্থাৎ পোলান্ড দখল করে পোলিশ সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে কিছুই পান নি হিটলার।

এরপর ১৯৪০ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ড আক্রমন করে হিটলার। ভয়াবহ লুটপাট চালায় সেখানে। নেদারল্যান্ডের সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে ১৬৩ মিলিয়ন ডলারের সমমুল্যের সোনা লুটপাট করে জার্মানি। নেদারল্যান্ড ছিলো একেবারেই অপ্রস্তুত। জার্মানির নেদারল্যান্ড আক্রমনটা ছিলো আনএক্সপেক্টেড।

 

এরপর বেলজিয়ামের পালা।

কিন্তু বেলজিয়াম অনুসরন করেছিলো পোল্যান্ডকে। ফলাফল, বেলজিয়ামের সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে হিটলার কিছুই পেলো না।

১৯৪০ সালের জুন মাসেই নাৎসি বাহিনীর হাতে ফ্রান্সের পতন হয়। প্যারিসের পতনের আগে ফ্রান্স তার ভল্টের সোনার একটা বড় অংশ পাঠিয়ে দেয় পশ্চিম আফ্রিকার ডাকার আর ক্যারিবিয় ফ্রেন্স কলোনিতে।

১৯৪২ সালে ভিসি ফ্রান্সের পাপেট সরকারকে দিয়ে হিটলার এসব সোনাদানার একটা বড় অংশ ফিরিয়ে আনে। হিটলার হয়ত গোল্ডের সমগ্র মজুদই নিজের কুক্ষিগত করতে পারতো, কিন্তু মিত্রবাহিনী ধীরে ধীরে জয় পেতে শুরু করে। প্রথমে আফ্রিকাতে, এবং পরে ইউরোপে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় স্তালিনগ্রাডের যুদ্ধের পর। এরপর ফ্রান্সে মিত্র বাহিনীর ল্যান্ডিং। সবমিলিয়ে হারতে শুরু করে হিটলারের পরাক্রমশালী বাহিনী। ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো সবারই হয়ত জানা। পূর্বে সোভিয়েত আর্মি, পশ্চিমে মার্কিন, ব্রিটিশ’দের মত সম্মিলিত মিত্র বাহিনীর কাছে জায়গা হারাতে শুরু করে নাৎসিরা।

 

এবার উল্টো হিটলার ব্যাকফুটে চলে যায়। এবার দেখুন ইন্টারেন্সটিং ব্যাপারটা।

সমগ্র বিশ্বযুদ্ধে একটি দেশ একেবারে নিউট্রাল ছিলো। সেটা হল সুইজারল্যান্ড। যেহেতু সে নিউট্রাল, সেহেতু সেই হিটলারের সাথে বিজনেস করতে পারবে। (ব্যাপারটা খেয়াল করুণ) সে যদি হিটলারের সাথে বিজনেস না করে, তাহলে সেটা হবে মিত্র বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়া। আবার সে মিত্র বাহিনীর সাথেও বিজনেস করবে। কারণ যদি সে মিত্র বাহিনীর সাথে বিজনেস না করে, তাহলে তার নিউট্রাল অবস্থান নষ্ট হবে। সে তখন হয়ে যাবে হিটলারের পক্ষের। অর্থাৎ নিউট্রালিটির নামে আসলে সে দুই ঘাটের পানিই খাবে। খেয়েছেও তা।

নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচতে প্রথম দিকে ইহুদীরা যেমন তাদের টাকা পয়সা সুইস ব্যাংকে জমা করতে শুরু করে, তেমন যখন হিটলার একটার পর একটা দেশ দখলে ব্যস্ত, তখন সেইসব দেশের মানুষেরাও তাদের টাকা পয়সার নিরাপত্তার জন্য সুইস ব্যাংকের শরণাপন্ন হয়। আবার যুদ্ধের শেষ দিকে যখন হিটলার আর তার নাৎসি জার্মানি ব্যাকফুটে চলে যায়, তখন তারাও তাদের টাকা পয়সার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শরনাপন্ন হয় সুইজারল্যান্ডের। অর্থাৎ গোটা বিশ্বযুদ্ধে সুইজারল্যান্ডের খালি লাভই হয়েছে। টাকা আর টাকা। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সোনা মজুদ হয়েছে সুইস ব্যাংকের ভল্টে।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পরার পর হিটলারের সাথে ইউরোপের প্রায় সবগুলো দেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। দীর্ঘ বিশ্বযুদ্ধ চালাতে হিটলারের প্রচুর অস্ত্রের দরকার পড়তে থাকে। সবটা জার্মানিতে প্রস্তুত করতে হিমশিম খেতে থাকে জার্মানি। ফলাফল, সুইজারল্যান্ডের কাছে ক্যাশের বদলে আর্টিলারি সেল কিনতে শুরু করে জার্মানি। (এতেও সুইজারল্যান্ডের নিউট্রালিটি খোয়া যায় নি। তার কথা, নিউট্রালিটি রক্ষায় সে হিটলারের সাথে বিজনেস করতে বাধ্য। বিজনেস না করলেই সেটা হবে মিত্র বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেয়া)

 

আবার জার্মান ও ইউরোপের অন্যসব দখল হয়ে যাওয়া দেশ থেকে ইহুদিরা প্রাণে বাঁচতে সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নিতে গেলে সেখানেও সুইজারল্যান্ড নিউট্রালিটি রক্ষায় ধুয়া তুলে হাত পরিষ্কার রাখে। নাৎসিরা ইহুদিদের পাসপোর্টে “J” লিখে দিতো। এই পাসপোর্টধারীদের সুইজারল্যান্ড সরকারকে আশ্রয় দিতে নিষেধ করেছিলো হিটলার। অপরদিকে আমেরিকা ও ব্রিটেন অনুরোধ করেছিলো সুইজারল্যান্ড’কে আশ্রয় দিতে। এবার সুইজারল্যান্ড নিউট্রালিটির বদলে ‘নিরাপত্তার’ অজুহাত দিলো। অর্থাৎ হিটলারের বিরুদ্ধে গেলে হিটলার সুইজারল্যান্ড আক্রমন করতে পারে। এই ভয়।

অর্থাৎ কখনো নিউট্রালিটি কখনো নিরাপত্তার অজুহাতে সুইজারল্যান্ড ফায়দা তুলেছে। হাত পরিষ্কার রেখেছে।এই টুকু পড়ার পর হয়ত আপনাদের মাথায় দুইটা প্রশ্ন জেগেছে। এক, হিটলার তো গোটা সুইজারল্যান্ড দখল করে নিলেই খেলা চুকে যেতো।

 

সূত্র- ইন্টারনেট, বিভিন্ন ব্লগ ও নিজে সংযোজিত

Facebook Comments

comments