আজ যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তা হলো হ্যান্ডগান।
গান পাউডার বা বারুদ আবিষ্কারের পর পরই মানুষ গান পাউডারের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষনা শুরু করে এবং অবশেষে (ধারনা করা হয়) ১৫শ সালের দিকে হ্যান্ডগানের আবিষ্কার হয়।
নিম্নে কিছু লেজেন্ডারি হ্যান্ডগান সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
Wheellock
উইল-লক পিস্তলের ডিজাইনার বলা হয় লিউনার্দো দ্যা ভিনচিকে। ধারনা করা হয় ১৫শ সালে এর জন্ম। উইল লক পিস্তলের স্প্রিং এর মত উইল থাকে যাকে ঘুরিয়ে র্স্পাক করানো হয় আর ঐ স্পার্ক থেকে গান পাউডারে আগুন লাগে আর গুলি ছুটে যায়। এর ইফেক্টিভ রেঞ্জ হচ্ছে ২০ গজ। তখন এর ম্যাকানিজম অনেক কঠিন হওয়াতে এর মূল্য অনেক ছিলো তাই এই পিস্তল সাধারন মানুষ বা মিলিটারীতে ব্যাবহার হতো না, রাজা বা রাজকীয় লোকেরা তাদের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য এই উইল-লক পিস্তল ব্যবহার করতো।
Flintlock
১৬শ সালের দিকে ফ্লিন্ট লক পিস্তলের জন্ম। উইল লক পিস্তলের ম্যাকানিজম ও দাম বেশি হওয়াতে অস্ত্র নির্মাতারা এর সহজ পথ খুজতে লাগলো এবং ফ্লিন্ট লক পিস্তল আবিষ্কার করলো। ফ্লিন্ট হচ্ছে একটা পাথর যা লোহার সাথে গষার ফলে স্পার্ক করে। এই পাথরকে ব্যবহার করে তৈরি হলো ফ্লিন্ট লক পিস্তল আর এতে নতুন যোগ হলো সেফটি ম্যাকানিজম। যা ছিলো খুবই সহজলভ্য ও রিলাইয়েবল। এই ফ্লিন্ট লক পিস্তলের ইফেক্টিভ রেঞ্জ হচ্ছে ২০+ গজ তবে এর প্রথম সমস্যা হচ্ছে পানিতে ভিজলে গুলি করা যেত না। জলদুস্যুদের সিনেমা গুলোতে ফ্লিন্ট লক পিস্তলের ব্যবহার দেখা যায়। ১৭শ সালের দিকে ইউরোপিয় পুরুষরা এই ফ্লিন্ট লক পিস্তল দিয়েই ডুয়েল করতো। এই ফ্লিন্ট লকের রাজত্ব চলে প্রায় দুইশত বছর (১৬০০-১৮০০) ধরে।
Percussion cap
প্রায় ২০০ বছর পর ১৮৩০ সালে ওয়াটার প্রুফ পিস্তল তৈরি হয়। ফ্লিন্ট পাথরের বদলে ছোট একটা ক্যাপ ব্যবহার হতো যার থেকে স্পার্ক করে ফায়ার করা হতো এবং এই পিস্তল যেকোন আবহাওয়াতে ব্যবহার করা যেত। এর ইফেক্টিভ রেঞ্জ ছিলো ২৫+ গজ।
Colt Single Action Army
দ্রুত গুলি করার জন্য পিস্তল জগতে আসলো রিভোলবার প্রযুক্তি। কোল্ট ১৮৬০ আর্মি এর পর ১৮৭৩ সালে আসলো লেজেন্ডারি কোল্ট সিঙ্গেল একশন আর্মি (কোল্ট পিসমেকার)। যাতে ছিলো প্রথম আধুনিক গুলি। এর ইফেক্টিভ রেঞ্জ ছিলো ২৫+ গজ আর .৪৫ ক্যালিবার এর বুলেট। এর একুরেসি, রিলায়েবিলিটির জন্য এর জনপ্রিয়তা আমেরিকায় আকাশচুম্বি হয়ে উঠে। কাউবয় থেকে মিলিটারী সব জায়গায় এই পিস্তলটা ছিলো সমানভাবে জনপ্রিয়। ওয়েস্ট্রান সকল কাউবয় সিনেমায় এই পিস্তলটা দেখতে পাবেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধের লেজেন্ডারী জেনারেল জর্জ এস প্যাটেন তার কোমড়ে সবসময় এই পিস্তলটা রাখতেন। আমেরিকার শৌখিন মানুষদের কাছে এই পিস্তলটা এখনো দেখা যায়। আর এই প্রযুক্তি ব্যাবহার করে আসে কোল্ট ৩৮ ডাবল একশন পিস্তল।
Luger
এই জার্মান সুন্দরী লুগার ১৯০৪ সালে প্রথম সার্ভিসে আসে। এটা সেমিঅটোমেটিক পিস্তল যা মিনিটে ১১৬টা গুলি করতে পারে । ইফেক্টিভ রেঞ্জ ৫০ মিটার। এতে ৭.৬৫ ও ৯.১৯মি.মি. কার্টিজ ব্যবহার করা হয়। এর গুলি কংক্রিট ভেদ করতে পারে। বিশ্বের প্রায় ২৪ টি দেশে এই পিস্তল ব্যাবহার হয়েছে। ১ম বিশ্বযুদ্ধ, ২য় বিশ্ব যুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধে এই পিস্তল ব্যবহার হয়েছে ।
Colt M-1911
রাইফেল জগতে যদি একে-৪৭ লেজেন্ডারী হয়ে থাকে তবে পিস্তল জগতে হবে আমেরিকান এম-১৯১১। এটা সিঙ্গেল একশন ও সেমি-অটোমেটিক, এর ডিজাইনার লেজে্ন্ডারী অস্ত্র নির্মাতা জন ব্রাউনিং। এই পিস্তল আমেরিকান আর্মি সার্ভিসে আনে ১৯১১ সালে এবং এখনো বিভিন্ন দেশে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। এর একুরেসি, ইফেক্টিভ ক্ষমতা, রিলাইবেলিটির জন্য এর জনপ্রিয়তা এখনো আগের মতই আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ২য় বিশ্ব যুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, গল্ফ যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ, আফগানিস্থান যুদ্ধ এবং বর্তমানে সিরিয়ান যুদ্ধেও এই পিস্তল ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ৬০+ দেশে এই পিস্তলটা ব্যবহার করে। এমনকি উত্তর কোরিয়াও তার স্পেশাল ফোর্সে এই পিস্তল ব্যাবহার করে। বাংলাদেশ RAB বর্তমানে এই পিস্তল ব্যবহার করে থাকে।
Browning Hi-Power
১৯৩৫ সালে এই পিস্তল সার্ভিসে আসে এবং এখনো সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। এর জনপ্রিয়তার কারনে বেলজিয়াম, কানাডা, চায়না, ইন্ডিয়া এর লাইসেন্স ভার্সন ব্যবহার করে। বিশ্বের প্রায় ৬০+ দেশে এর ব্যবহার হয়ে থাকে (বাংলাদেশও ব্যবহার করে)। এমনকি ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিরা বেলজিয়াম দখল করার পর এই পিস্তল সাড়ে তিন লাখের মত তাদের সার্ভিসে নেয়। এটি সেমি-অটোমেটিক, কার্তুজ ৯মি.মি এবং ইফেক্টিভ রেঞ্জ ৫০+ মিটার। ২য় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ফকল্যান্ড যুদ্ধ, ইরাক ও আফগানিস্থান যুদ্ধেও এই পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে।
Walther P38
নাৎসি জার্মানিতে ১৯৩৮ সালে স্ট্যান্ডার্ট ইস্যু হিসেবে এই পিস্তলটা আসে। এটা দেখতে অনেকটা লুগারের মত কিন্তু লুগারের চেয়ে বেশি ইফেক্টিভ। এটা প্রায় দশ লক্ষের উপর বানানো হয়। এর কার্তুজ হিসেবে ব্যবহার হয় ৯ মি.মি. এবং ইফেক্টিভ রেঞ্জ ৫৫ গজ। পৃথিবীর অনেক দেশে এখনো সার্ভিসে আছে এই পিস্তলটা।
Walther PP
এর জন্ম নাৎসি জার্মানিতে। এই পিস্তলটা প্রায় অনেকেরই চিনার কথা যদি জেমস বন্ড সিনেমা দেখে থাকেন। কারণ, জেমস বন্ড এই পিস্তলটা ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এই পিস্তলটা ব্যাবহার করেন। বিভিন্ন রকম কার্তুজ ব্যবহার হয় এই পিস্তলে।
Tokarev TT-30
সোভিয়েত মিলিটারীর জন্য ১৯৩০ সালে এই সেমি-অটোমেটিক পিস্তল সার্ভিসে আসে। এটা বেশ জনপ্রিয় পিস্তল যার কারনে এখনো সার্ভিসে আছে। এটি ২য় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ান, ভিয়েতনাম, চিনের গৃহযুদ্ধ, সিরিয়ার যুদ্ধে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন দেশ এর লাইন্সে ভার্সন ব্যবহার করেন। বাংলাদেশ এর চাইনিজ লাইসেন্স ভার্সন টাইপ-৫৪ ব্যাবহার করে।
Makarov Pistol
এটা মূলত জার্মান ওয়াল্টার পিপি কে মাথায় রেখে বানানো হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ পরবরর্তীতে প্রায় সকল যুদ্ধেই এই পিস্তল ব্যবহার হয়। রাশিয়ান স্পেৎনাজ এই পিস্তল স্পেশাল অপারেশনে ব্যবহার করে। পৃথিবীর প্রায় ৫০+ দেশে এই পিস্তল ব্যাবহার হয়। চীন এর লাইন্সে ভার্সন টাইপ-৫৯ ব্যবহার করে।
SIG Sauer P226
SIG Sauer P226 হচ্ছে জার্মান আরেক মাস্টারপিস। এই পিস্তল ১৯৮৩ সালে সার্ভিসে আসে এবং আমেরিকা ও ইংল্যান্ড সহ পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ পুলিশ, সিকিউরিটি ফোর্স, স্পেশাল ফোর্সের কাছে বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশ নেভি সোয়াডস ও বাংলাদেশ প্যারা কমান্ডোরা এই পিস্তল ব্যবহার করেন।
Glock
গ্লক ডয়েস (জার্মান) জাতির আরেক মাস্টারপিস, মূলত এর জন্ম অস্ট্রিয়াতে। এর ডিজাইনার গ্যাসটন গ্লক। এই পিস্তল বর্তমান যুগের লেজেন্ড। পৃথিবীর প্রায় সব স্পেশাল ফোর্সই তাদের অস্ত্র তালিকায় এই অস্ত্রটা রাখতে চায়। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, ফ্রান্স, ইজরায়েল, চীন, ইন্ডিয়া, পাকিস্থান সহ প্রায় সব দেশেই এটা ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশও এই পিস্তল ব্যবহার করে। মিলিটারী থেকে সিভিলিয়ান পর্যন্ত সবার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় পিস্তল হচ্ছে Glock.
এই পিস্তলের বিশেষত্ব হচ্ছে সেমি-অটো ও ফুল অটোতে ফায়ার করতে পারা। এর ইফেক্টিভ রেঞ্জ হচ্ছে ৫০ গজ আর রেট অফ ফায়ার মিনিটে ১২০০ রাউন্ড বলা চলে হাতের মুঠোয় এমজি-৪২ মেশিন গান।
হ্যান্ডগানের ব্যবহার যেমন থেমে নেই, তেমনি হ্যান্ডগান প্রযুক্তির উদ্ভাবনও থেমে নেই। যার কারনে হ্যান্ডগান এবং কার্টিজ গুলো দ্রুত স্মার্ট হচ্ছে এবং অনেক আগেই চলে এসেছে স্মার্ট হ্যান্ডগান। যা শুধুমাত্র মূল ব্যবহারকারীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর সাহায্যে একটিভ হয়। প্রযুক্তির উন্নয়ন হতে হতে হয়তোবা কোন একসময় হ্যান্ডগানের ব্যবহার সীমিত হয়ে যাবে কিন্তু উপরে আলোচিত লেজেন্ডারি হ্যান্ডগান গুলোর নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।
মূল লেখায়ঃ সিফাত আদনান ও এডমিন কর্তৃক সংযোজিত।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.