আপনি কি জানেন Mercenary Soldier কি ???
কথাটা ইংরেজিতে বললে মার্সেনারী সৈনিক হচ্ছে “who fights for any state or nation without regard to political interests or issues.” নিজ দেশের বাহিরে অন্যজাতি বা দেশের জন্য যুদ্ধ করা সৈনিকদের বলা হয় মার্সেনারী সৈনিক।
সোজা কথায় বিদেশী সৈন্যদলে কর্মরত বেতনভোগী সৈনিক। আজ আমি পৃথিবীর সেরা ভাড়াটে সৈনিকদের কথা বলবো।
এই বিখ্যাতো যোদ্ধাদের জন্ম নেপালে হিমালয়ের পাদদেশে। নেপালে ??!!?? ভুল শুনলেন না তা ??? না ভুল শুনেন নাই , ঠিকই শুনেছেন।
তো ভাই তাদের মধ্যে কি আছে ??? কি আছে সেটা পরে বলছি তবে এতটুকু শুনে রাখুন গত দুইশো বছর যাবৎ ব্রিটিশ আর্মিতে গর্বের সাথে তারা সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে । হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন তারাই – Gurkha
গোর্খা আসলে কারাঃ গোর্খাদের জন্ম নেপালে হয়ে থাকে (সব নেপালি কিন্তু গোর্খা না)। “Better to die than be a coward” এই মটোতে তারা বিশ্বাসী। এরা সাধারনত ৫ ফুট ২ থেকে ৫ ফুট ৫ পর্যন্ত হয়ে থাকে (এভারেজে)। এদের ক্ষীপ্রতা, সাহসিকতা, আনুগত্য ও ডিসিপ্লিনের জন্য এদের বর্তমানে পাঁচটা দেশ (নেপাল সহ) রিক্রুট করে থাকে। গোর্খাদের বিশাল বড় মিলিটারী ট্রেডিশন রয়েছে। যেমন দাদার দাদা যুদ্ধ করেছেন সিপাহি বিদ্রোহে , দাদা যুদ্ধ করেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, বাবা যুদ্ধ করেছেন ২য় বিশ্বযুদ্ধে , ছেলে যুদ্ধ করেছেন ফকল্যান্ড যুদ্ধে। যুদ্ধটা আসলে তাদের রক্তের সাথে মিশে গেছে, বেশিরভাগ গোর্খা ছেলেরাই কৈশর থেকে স্বপ্ন দেখে বাবা বা দাদার মত যোদ্ধা হওয়ার।
গোর্খাদের কমন একটা অস্ত্র আছে যা সবসময় তারা বহন করে আর এর নাম হচ্ছে “Kukri”, ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা বাকানো ছুড়ি যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সব যুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে। আর তাদের স্পেশাল একটা Gurkha Hat আছে যা তারা বাকা করে মাথায় পড়ে।
যদি ইতিহাসে চলে যাই তবে শুরু করতে হবে ১৮১৪ সাল থেকে। তখন ভারত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা শাসিত আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তাদের সীমানা বৃদ্ধি করার জন্য প্রায় ২২ হাজার প্রশিক্ষিত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈনিক নিয়ে নেপালে আক্রমণ করে। ব্রিটিশরা ভেবেছিলো যেমন বাঙালীদের বোকা বানিয়ে দখল করেছিলো তেমনিই হয়তো নেপালে আক্রমণ করলে তারাও ভয়ে আত্মসমর্পণ করবে।
কিন্তু সেখানে বিপরীত চিত্র দেখা গেলো, স্থানীয় নেপালি (গোর্খালী) প্রায় ১২ হাজার সাধারন মানুষ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। না ছিলো কোন সামরিক প্রশিক্ষন না কোন আধুনিক অস্ত্র, ব্রিটিশরা দেখলো শুধু মাত্র তাদের নিজেদের বানানো ছুড়ি – Kukri দিয়ে আধুনিক ব্রিটিশ সৈনিকদের দফারফা করে ছেড়ে দিচ্ছে।
এই বিষয়টা ব্রিটিশ অফিসারদের মনে খুব আতংক সৃষ্টি করলো, তারা বুঝতে পারলো গোর্খারা আসলে অন্য জিনিশ। এই যুদ্ধ ১৮১৪-১৮১৬ পর্যন্ত চললো এবং যুদ্ধ শেষে তাদের দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হলো যে গোর্খা ছেলেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মিলিটারীতে সার্ভিস দিবে। এই চুক্তির নাম “Treaty of Sugauli” ( এই চুক্তিতে আরো অন্য বিষয় ছিলো, গুগল করে দেখতে পারেন)।
প্রথম গোর্খা রেজিমেন্ট যা ১৮১৫ সালে তৈরি হয় (চুক্তি হয়েছিলো ১৮১৬ তে কিন্তু রেজিমেন্ট গঠিত হয় ১৮১৫ তে)। এই রেজিমেন্টের নাম ছিলো 1st King George’s Own Gurkha Rifles (প্রায় ৫ হাজার গোর্খা নিয়ে গঠিত হয়েছিলো) বর্তমানে এর নাম ফাস্ট গোর্খা রাইফেল। এরপর যথাযথভাবে সেকেন্ড ও থার্ড গোর্খা রাইফেল রেজিমেন্ট গঠিত হয়। এরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে তারা ১৮১৭ সালে মারাঠা রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, ১৮২৬ সালে তারা রাজস্থানের রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৮৪৬ ও ১৮৪৮ সালে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় আনে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় তারা ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানির প্রতি অনুগত থাকে এবং ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করে।
১৮৫৭ সালের যুদ্ধের পর কোম্পানি শাসনের অবসান হলে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে গোর্খারা সার্ভিস দিতে শুরু করে। বলা চলে ব্রিটিশদের পরবর্তী সকল যুদ্ধে নেপালী গোর্খারা যুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় ২ লক্ষ নেপালী গোর্খা ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য দুইজন নেপালী গোর্খাকে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ সামরিক পদক ভিক্টোরিয়া ক্রস প্রদান করেন।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোর্খারা মিয়ানমারে (তৎকালীন বার্মা) জাপানীদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো। বার্মার এক জঙ্গলে ৮০ জন জাপানী সৈনিককে ৩০ জন গোর্খা এমনভাবে হত্যা করেছিলো যে তারা বুঝতেই পারে নাই কারা আক্রমন করেছে। বার্মাতে একজন গোর্খা সৈনিক এক হাত দিয়ে (আরেক হাত বোমায় উড়ে গিয়ে ছিলো) বোল্ট একশন লি এনফিল্ড রাইফেল দিয়ে ২০০ জাপানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে (৩১ জন মারা গিয়েছিলো তার গুলিতে) এবং জাপানীরা পালাতে বাধ্য হয়। যুদ্ধ শেষে তার এই অসামান্য সাহসিকতার জন্য ভিক্টোরিয়ান ক্রস দেয়া হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ১০ জন নেপালি গোর্খাকে সর্বোচ্চ সম্মান ভিক্টোরিয়ান ক্রস দেয়া হয়।
২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় গোর্খা রেজিমেন্ট ছিলো ১০টি (১-১০ গোর্খা রাইফেল)। ১৯৪৭ এ ভারত যখন স্বাধীন হয়ে যায় তখন গোর্খাদের সাথে একটা চুক্তি হয়, চুক্তির নাম Tripartite Agreement। এই চুক্তি অনুসারে গোর্খা দশটা রেজিমেন্টকে ভাগ করে ৪টি নেয় ব্রিটিশরা আর ৬টি নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। এই চুক্তিতে যারা ব্রিটিশ আর্মিতে সার্ভিস দিবে তাদের বেতন ব্রিটিশ সৈনিকদের সমান এবং যারা ভারতীয় বাহিনীতে সার্ভিস দিবে তাদের ভারতীয় বাহিনীর সমান বেতন দিতে হবে।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ গোর্খাবাহিনী ফকল্যান্ড, আফগানিস্থান ও ইরাকে যুদ্ধ করে। আর ইন্ডিয়ান গোর্খারা ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ, ৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধ (পার্বত্য চট্রগ্রামে) , কার্গিল যুদ্ধে অসামান্য সাহসিকতা দেখায়। ইন্ডিয়ান আর্মির বেস্ট অফিসার গুলোকে গোর্খা রেজিমেন্টে পাঠানো হয়। ইন্ডিয়ান আর্মির তিনজন জেনারেল বা চিফ অফ স্টাফ গোর্খা রেজিমেন্ট থেকে এসেছেন, এর মধ্যে একজন পাচঁ তারকা খচিত বা ফিল্ড মার্শাল।
ইন্ডিয়ান আর্মির লেজেন্ডারী জেনারেল স্যাম মানেক শো (পাচঁ তারকা) গোর্খাদের সাহসিকতা নিয়ে উক্তি করেছেন,
“ If a man says he is not afraid of dying, he is either lying or is a Gurkha.”
গোর্খাদের বর্তমান অবস্থাঃ ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীতে বর্তমান ৭ টা গোর্খা রেজিমেন্ট রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় দুই হাজারের মতো গোর্খা রিক্রুট করে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী। প্রায় ৪০ হাজারের মত গোর্খা চাকুরি করে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীতে (ইন্ডিয়াতে এত কোটি মানুষ থাকা সত্যেও তারা গোর্খাদের নেয় শুধু মাত্র তাদের যোগ্যতার জন্য)। আর প্রায় ২৫ হাজারের মতো গোর্খা চাকুরি করে ইন্ডিয়ান প্যারা মিলিটারী ফোর্সে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নেপাল থেকে প্রতিবছর প্রায় ২৫০ এর মতো থেকে গোর্খা নিয়ে থাকে। (উল্লেখ্য, নেপালের পাশাপাশি উত্তর ভারতেও বর্তমানে গোর্খাদের বাস, যেটি দার্জিলিং বা গোর্খাল্যান্ড নামে পরিচিত)।
কমনওয়েলথ্ এর অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুর পুলিশে এখনো নেপাল থেকে গোর্খা নিয়ে থাকে। গোর্খাদের সিলেক্ট করার সময় নেপালে ব্রিটিশ আর্মির অফিসাররা এসে থাকে। তাদের সিলেকশনই শুরু হয় ৪০ কেজির উপর পাথরের ঝুড়ি নিয়ে পাহাড়ে দৌড়ে।
গোর্খারা তাদের নিজেরে দেশের সেনাবাহিনীতে ও পুলিশে সার্ভিস দিয়ে থাকে। গত ২০০ বছরে ব্রিটিশদের প্রতিটি যুদ্ধে গোর্খারা ব্রিটিশদের কাধে-কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে , ব্রিটিশদের প্রতি তাদের আনুগত্যের জন্য ব্রিটিশরা গোর্খাদের অনেক বেশি সম্মান করে। তাদের মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্সের পাশেই বিশাল গোর্খা সৈনিকের মূর্তি লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে ৭১ বছর যাবৎ সফলতার সাথে ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিচ্ছে এই মার্চেন্টাইন যোদ্ধারা।
গোর্খারা প্রমাণীত প্রকৃত যোদ্ধা হিসেবে, যুদ্ধটা আসলে তারা জানে। গোর্খা ছেলেরা যখন বুঝতে চেষ্টা করে তখনই তাদের হাতে Kukri তুলে দেয়া হয়।
আরো কিছু ছবিঃ
ওদের ব্যাপারে লিখে আসলে সব তথ্য দেয়া সম্ভব না। কারো যদি আরো জানতে ইচ্ছা করে তবে গুগল তো আছেই। আমি আমার মত তথ্য দেয়ার চেষ্টা করেছি ভুল হলে শুধরে দিবেন। ধন্যবাদ
লেখায়ঃ সিফাত আদনান ও নিজে সংযোজিত
Leave a Reply