স্নায়ুযুদ্ধের সময় থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা চলতো সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে, তবে অস্ত্র প্রতিযোগিতাই ছিলো মুখ্য। অনেক সময় দেখা যেত এক দেশের দেখাদেখি অন্য দেশ তা অনুকরণ করে ফেলেছে। এরকম অনেক নজির রয়েছে যেমন আমেরিকা সাবমেরিন প্রযুক্তিতে সোভিয়েত আমলে শিশুতুল্য ছিল। তবে তা হাতিয়ে নেয়া এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে বর্তমানে সমান সমান বলা যায়। এরকমভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নও অনুকরণ ও নিজস্ব প্রতিভায় স্বমহীমায় মহাকাশ গবেষণার শিখরে পৌছে গিয়েছিল!
সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে এবার বুঝি আর রক্ষা পাওয়া যাবে না। মার্কিনীরা এমন এক মহাকাশযান তৈরি করছে যা মহাকাশে গিয়ে প্রায় অক্ষত অবস্থায় আবার ফিরে আসতে পারে এবং এটি পারমাণবিক বোমা বহনেও সক্ষম!
মার্কিনীরা মহাকাশযানটির নাম দিয়েছে ‘স্পেস শাটল’।

Space Shuttle
স্নায়ুযুদ্ধে টিকে থাকতে হলে এখন সোভিয়েতদেরও চাই এমন একটি মহাকাশযান যেটা কাজ করবে ঠিক মার্কিনীদের মহাকাশযানের মতো কিংবা তার থেকেও বেশি। স্নায়ুযুদ্ধের সময় এভাবেই শুরু হয় পুনরায় ব্যাবহারযোগ্য মহাকাশযান বানানোর প্রতিযোগিতা। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক ডিক্রির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ‘বুরান-এনারজিয়া’ প্রজেক্ট।

Project Buran Energia
সোভিয়েত রকেট বিজ্ঞানীরা ঠিক মার্কিনীদের মতোই একটি যান প্রস্তুত করতে থাকেন। তবে এটি আরো উন্নত সংস্করণ! বুরানকে মোট ১০ জন নভোচারী বহনের ক্ষমতা সম্পন্ন করে প্রস্থুত করা হয়। এর ওজন বহন ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়। এটি ৩০ টন পরিমাণ ভর নিয়ে মহাকাশে যেতে পারত এবং ফিরে আসতে পারত ২০ টন নিয়ে। এর গায়ে তাপ নিরোধক প্রায় ৩৮০০০ টি টাইলস বসানো ছিল। কাজাখাস্থানের বৈকনুর কসমোড্রামের এক গোপন কারখানায় শুরু হয় এই প্রজেক্ট। রুশ ভাষায় বুরান শব্দের অর্থ ‘তুষার ঝড়’।

Baikonur Cosmodrome
মূল যান প্রস্তুত করার দায়িত্ব পায় সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন রকেট প্রস্তুতকারক কোম্পানি RKK Energia প্রস্তুতকারক দলের প্রধান ছিলেন রকেট বিশেষজ্ঞ ‘গ্লেভ লোজিনো-লোজিনস্কি’, যিনি এর আগে ‘স্পাইরাল’ প্রজেক্টে কাজ করেছিলেন। তার সাথে যুক্ত হয় ১২০০ প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ এবং সোভিয়েত সরকারের প্রায় ১০০ মিনিস্ট্রি। বাজেট ধরা হয় প্রায় ১৪.৫ বিলিয়ন রুবল।

BURAN 1.01
যে বৈশিষ্ট্যটি বুরানকে মার্কিন স্পেস শাটল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করেছিল তা হলো, প্রকৌশলীরা একে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতা সম্পন্ন করে প্রস্তুত করেন। মানুষ্যবিহীন অবস্থায় মহাকাশে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে। সালটা ১৯৮৮, দিনটা ১৫’ই নভেম্বর, বুরান তার প্রথম উড্ডয়ন সম্পন্ন করে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে। মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীকে ২০৬ মিনিটে দুইবার প্রদক্ষিণ করে নিরাপদে ফিরে আসে।
“২০১০ সাল পর্যন্ত বুরান ছিল একমাত্র মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান যেটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিল”
বুরানের এই কীর্তি সোভিয়েত নেতাদের গোপনীয়তার কারণে দীর্ঘদিন পৃথিবীর মানুষ জানতে পারেনি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বিমান An-225 Cossack বিমানটি ডিজাইনের উদ্দেশ্যই ছিল বুরানকে কম খরচ ও কম জটিলতায় একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌছে দেয়া যেখান থেকে মনুষ্যবিহীন কিংবা মনুষ্যযোগে বুরান অটোমেটেড ফ্লাইট করতে পারবে স্পেসে।

মিগের স্কর্টে ‘বুরান’কে পিঠে নিয়ে এএন-২২৫
এর কিছুদিন পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে, পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে অন্য অনেক প্রজেক্টের মতো ‘বুরান’ প্রজেক্টও বন্ধ হয়ে যায়। ৩০ জুন ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিন আনুষ্ঠানিকভাবে বুরান প্রজেক্টের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এই প্রজেক্টে বুরানের কিছু প্রোটোটাইপ তৈরি হয়, যাদের একটির নাম ‘পিচকা’ এর কাজ ৯৭% সম্পন্ন হবার পর বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি প্রোটোটাইপ ‘বৈকাল’ এর ৫০% কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এটি দীর্ঘদিন ধরে অনেক অবহেলায় একটি পুরনো গাড়ির গেরেজে পড়ে ছিল। মস্কোর ম্যাক্সিম গোর্কি পার্কের দর্শকরা সকাল-বিকাল দেখে তাদের স্বপ্নের করুণ অবস্থা। এখানেও রাখা আছে বুরানের একটি প্রোটোটাইপ। পর্যাপ্ত দেখভালের অভাবে যেটি ধ্বংসপ্রায়!

ম্যাক্সিম গোর্কী পার্কে অবহেলায় পড়ে আছে ‘বুরান’
বুরান গল্পের শুরু হয় ১৫’ই নভেম্বরের এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে আর এই গল্প শেষ হয় ১২ ই মে ২০০২ সালের এক বৃষ্টিভেজা দিনে। কিছু কর্মী কাজাখাস্থান কসমোড্রামের হ্যাজ্ঞার ১১২ মেরামত করছিল যেখানে রয়েছে বুরান ১.০১ একমাত্র এই মডেলটিই পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছিল। মেরামতের এক পর্যায়ে হ্যাজ্ঞারটির ছাদ ধ্বসে পড়ে! এই দুর্ঘটনায় ৭ কর্মীর মৃত্যু হয় পাশাপাশি মৃত্যু হয় এক রঙিন স্বপ্নের! জন্ম হয় নতুন এক রুশ রুপকথার, যার নায়ক এক নিসঃঙ্গ মহাকাশযান! প্রায় ১৫ বিলিয়ন রুবল বাজেটের এই প্রজেক্টের কোনো মেটারিয়ালই পরবর্তীতে কোথাও ব্যবহার করা হয়নি।

অবশেষে ছাদ ধসে পড়ে মৃত্যু হয় একটি সম্ভাবনাময় আবিষ্কারের
রুশ মহাকাশ একাডেমির বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ঝিলকিয়ানভের কণ্ঠে নিদারুণ হতাশা ফুটে ওঠে- “Buran Was Made To Shine In Space, But Finally It Died On Earth”
কিছু ছবিঃ

জার্মানীর টেকনিক মিউজিয়ামে ‘বুরান’

বুরান এর ইঞ্জিন

ধ্বংসস্তূপে বুরান

এএন-২২৫ দানবের পিঠের উপরে ‘বুরান’ কে বসানো হচ্ছে
লেখায়ঃ জিরো টু ইনফিনিটি ও এডমিন কর্তৃক সংযোজিত।
Leave a Reply