কোরীয় দায়েয়ু হেভি ইন্ডাস্ট্রির তৈরি এই উলসান ক্লাস লাইট ওয়েট ফ্রিগেট গুলো দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশ ব্যবহার করে। বাংলাদেশের জাতীর জনক শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু উপাধি অনুযায়ী এর নাম করন করা হয় বিএনএস বঙ্গবন্ধু। বিএনএস বঙ্গবন্ধু ২০০১ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ হিসেবে দায়িত্বপালন করছে। কিন্তু হঠাৎ ২০০২ সালে একে মেরামতের জন্য পাঠানো হয় এবং এতে ওয়েস্টার্ন টেকনোলজি সংযোজন করা হয় কাজেই এটি অন্যান্য উলসান ক্লাস অপেক্ষা আপগ্রেড। ২০০৭ সালে এর নামান্তর করা হয় বিএনএস খালিদ বিন ওয়ালিদ এবং ২০০৯ সালে এটিকে আবার পূর্বের নামেই নামান্তর করা হয়। ২০১২ সালে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত এক্সারসাইজ ফেরোসাস ফ্যালকন এবং ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট-৩৭০ এর রেস্কিউ অভিযানে বিএনএস বঙ্গবন্ধু অংশগ্রহণ করে।
বিএনএস বঙ্গবন্ধু ফ্রিগেটটি সাধারণত দৈর্ঘ্যে ১০৩.৭ মিটার, বীম ১২.৫ মিটার, ড্রাফট ৩.৮ মিটার। প্রায় ২৫০০ টনের এই ফ্রিগেটটিতে একটি ২ শ্যাফট এর ডিজেল ইঞ্জিন আছে, যা প্রায় ১৭ মেগাওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে। ফ্রিগেটটি ১৬ জন অফিসার সহ মোট ১৮৬ জন নৌসেনা এবং প্রয়োজনীয় রসদসামগ্রী নিয়ে ২৫ নট গতিতে দীর্ঘদিন সমুদ্রে নজরদারী চালাতে পারে।
এর অস্ত্র ব্যবস্থা নিয়ে কম বেশি সবাই আমরা জানি।নিম্নে এর অস্ত্রশস্ত্র ও সেন্সর সহ বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
এতে প্রাইমারি অস্ত্র হিসাবে আছেঃ
- ০১ টি অটোব্রেডা ৭৬মি.মি./৬২ সুপার র্যাপিড গান
- ০৪ টি অটোব্রেডা ৪০মি.মি./৭০ কম্প্যাক্ট কিউস
- ০৮ টি এফএম-৯০এন বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র
- ০৮ টি অটোম্যাট মার্ক-২ ব্লক-৪ এন্টিশিপ মিসাইল
- ০৬ টি ৩২৪মি.মি. হোয়াইটহেড এ-২৪৪এস টর্পেডো
- ০২ টি সুপার ব্যারিকেড চ্যাফ লঞ্চার
এতে এন্টিশীপ মিসাইলের জন্য ০৪ টি লঞ্চার আছে যাতে ০৪ টি মিসাইল থাকে এবং বাকি ০৪ টি স্টোরেজে স্টক হিসাবে রাখা হয়। যেগুলো ম্যানুয়াল লোড এর মাধ্যমের লঞ্চারে যুক্ত করা হয়।

76mm Super Rapid Gun

FM-90 Short Range SAM

Otomat Mk-ii

Oto Bereda 40mm CIWS
রাডার এবং সেন্সরঃ বিএনএস বঙ্গবন্ধুতে ব্যবহার করা হয়েছে একটি লো ফ্রিকোয়েন্সি ডুয়েল ব্যান্ড এস-ব্যান্ড 2D ডিএ০৮ এরিয়াল সার্চ রাডার। যা যেকোন আবহওয়ায় এর কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম। এই রাডার লো-ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে যার ফলে ইলেক্ট্রিক কাউন্টার মেজার সিস্টেমে ধরা পড়ার সম্ভাবনা খুব কম। এর সবচেয়ে ভাল দিক হলো এর এক্যুরেসি, যার জন্য এটি এর সমগোত্রীয় রাডার গুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে। এই সিস্টেম টি কোন কিছু ট্র্যাক করে তার 2D ছবি তৈরী করতে সক্ষম এবং ফ্রেন্ড & ফো টার্গেট অটোমমেটিক ভাবে নিশ্চিত করতে পারে। সেই সাথে এতে থাকা TWT ট্রান্সমিটার এর মধ্যমে শত্রু জাহাজ থেকে পাঠানো রাডার জ্যামার সিগন্যাল কে কাউন্টার করে রাডারকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। যদিওবা এই রাডার রেঞ্জ সম্পর্কে এখনও তেমন কিছু জানা যায়নি, তবুও অনেক এক্সপার্টদের মতে এর রেঞ্জ ২৫০ কি.মি এর কম নয়। এই রাডারের ডিজাইনের কারনে ইলেক্ট্রনিক কাউন্টার মেজার দিয়ে একে কাউন্টার করা যথেষ্ট কঠিন।
এই ফ্রিগেটে সেকেন্ডারি রাডার হিসাবে আছে একটি ভ্যারিয়েন্ট X/C ব্যান্ড সার্ফেস সার্চ রাডার এর রেঞ্জ ৮০ কি.মি। যদিওবা এর রেঞ্জ কম তবুও সলিড স্টেট রাডার হওয়ায় এর ইলেক্ট্রনিক কাউন্টার মেজার ক্ষমতা যথেষ্ট ভাল। তবে বাংলাদেশ নেভি এর মিড লাইফ আপগ্রেড করতে যাচ্ছে সেইসাথে এই রাডার পরিবর্তন করে কেলভিন হুগি X-ব্যান্ড রাডার ব্যবহার করার চিন্তা করছে যার রেঞ্জ ১৮০ কিলোমিটারেরও বেশি। এছাড়া এতে একটি কেলভিন হুগি-১০০৭ আই ব্যান্ড নেভিগেশন রাডার আছে যার রেনজ ১০০ কিমি। এটি বিশ্বের অন্যতম বহুল ব্যবহৃত নেভিগেশন রাডার।
অনবোর্ড ইন্ট্রিগেশন সিস্টেমঃ বিএনএস বঙ্গবন্ধুতে ইন্ট্রিগেশন সিস্টেম হিসেবে আছে Thalas LINK-Y MK TDS যা ন্যাটো বহির্ভভূত দেশগুলোর জন্য বানানো। এই সিস্টেমটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল, এটি একই সাথে সোভিয়েত স্টান্ডার্ড লিংক-১১ এবং ন্যাটা স্টান্ডার্ড লিংক-১৬ এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা একসাথে ৩১ টি জাহাজ অথবা বিমান অথবা মিসাইলের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং সেগুলো ৩ সেকেন্ডের ও কম সময়ে বিশ্লেষন করে সম্পূর্ন তথ্য প্রদান করতে সক্ষম। এই সিস্টেম মিশন এর উপর ভিত্তি করে ৩ টি ভিন্ন মোডে কাজ করেঃ
- এয়ারবর্ন ইন্ট্রিগেশন
- শীপবর্ন কমব্যাট ম্যানেজার এবং
- অফসোর ইন্ট্রিগেট
এই সিস্টেম টি অভার দ্যা হরিজন ইন্ট্রিগেট (Over The Horizon) করতে পারে।
MOC Mk-3: হলো একটি মাল্টিফাংশন C3I কমান্ড কন্ট্রোল এন্ড কমিউনিকেশন সিস্টেম যা জাহাজ এর কমান্ডিং অফিসার এর সাথে জাহাজে থাকা ক্রু এবং অন্য জাহাজে সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে। এই সিস্টেমের অধীনে কমান্ডিং অফিসার অপারেশন চলাকালীন সকল আপডেট নিতে সক্ষম এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কখন কি ব্যবহার করা হবে তার আদেশ এবং চাইলে ওয়েপন অফিসারের অবর্তমানে সরাসরি নিজেই অস্ত্র পরিচালনা করতে সক্ষম! সেক্ষেত্রে এই সিস্টেম অটোনোমাস ভাবে সেই অস্ত্র ব্যবস্থা কে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং লক্ষ্য ঠিক করে ফায়ার করবে। আর এর জন্য এই সিস্টেম টি জাহাজে থাকা সকল সেন্সর এর সাথে যুক্ত।
TACTICOS: এটি একটি ন্যাটো স্টান্ডার্ড মিশন কন্ট্রোল ইন্ট্রিগেট সিস্টেম যা মিশন এর সকল আপডেট কে একত্রিত করে মিশন পূর্ববর্তী সকল কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করতে সক্ষম। এটি মুলত ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে দ্রুত তথ্য বিশ্লেষন করে সেই অনুযায়ী কমান্ডিং অফিসারকে জাহাজ সমন্ধে সিধান্ত নিতে সাহায্য করে। সেইসাথে এটি জাহাজের সেন্ট্রাল লিংক হিসাবে কাজ করে যখন জাহাজের ক্রুদের পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই মিশন পরিচালনার দ্বায়িত্ব নিতে হয়।
CUTLASS-242 ESM: এটি হল শীপ বেসড ইলেক্ট্রনিক সার্পোট সিস্টেম, যেটি মুলত শত্রু জাহাজ থেকে প্রেরন করা লো ব্যান্ড রেডিও ওয়েভ কে গ্রহন করে তার অবস্থান নির্নয় করে। এই সিস্টেমটি একটি ন্যাটো গ্রেড সিস্টেম যা ১গিগাহার্জ থেকে ১৮ গিগাহার্জ পর্যন্ত যেকোন ওয়েভ ব্যান্ড কে খুজে বের করতে সক্ষম। যদি কখনো রাডার দ্বারা কোনো জাহাজকে খুজে বের করতে সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে এই সিস্টেমটি শত্রু জাহাজ থেকে প্রেরন করা রাডার ওয়েভ কে গ্রহন করে তা খুজে বের করতে পারে। সেইসাথে লো-ব্যান্ড ইন্টারসেপ্ট ক্যাপাসিটি থাকায় যতই লো-ব্যান্ড রাডার হোক না কেনো সেটিকে নির্নয় করতে সক্ষম এবং নির্নয় করা মাত্র ৯ মিলি সেকেন্ডে এটি তার সকল তথ্য সহ পূর্ন ছবি তৈরীকরে মিশন কম্পিউটারে প্রেরন করতে সক্ষম। এই সিস্টেমটি আসে পাশে থাকা ১৫০টি হাই প্রায়োরিটি টার্গেট কে বাছাই করে তাদের অবস্থান বের করতে পারে এবং সর্বোচ্চ ২০০০ রাডার সিগ্নাল খুজে বের করতে পারে।
Scorpion Jammer: স্করপিয়ন জ্যামার কে কাটলাস এর একটি সাব সিস্টেম বলা যায়। স্করপিয়ন জ্যামার আর কাটলাস ইসিএম কে একসাথে অক্টোপাস কমব্যাট সিস্টেম বলা হয়। এর কারন হল কাটলাস যখন শত্রু জাহাজের রাডার ওয়েভ খুজে বের করে তখন মিশন কম্পিউটার এর দ্বারা কোন ওয়েভ টি জাহাজের জন্য বিপদজনক তা নির্নয় করে এবং স্করপিয়ন জ্যামার অটোনমাস ভাবে তার দিকে রেডিও ওয়েভ ছুড়তে থাকে, ফলে সেই রাডার ফলস ওয়েভ গ্রহন করতে থাকে এবং সঠিক তথ্য না পেয়ে জ্যাম হয়ে যায় বা জ্যাম করে দেয়া হয়। এই সিস্টেম টি এতটাই কার্যকর যে ন্যাটো দেশভুক্ত অনেক দেশ তাদের জাহাজে এই সিস্টেমটি ব্যবহার করে।
LIROD MK2: এটি একটি ফায়ার কন্ট্রোল রাডার যা হেভি ECM এর ভিতরে কাজ করতে সক্ষম। এটি Thalas এর তৈরী একটি রাডার এবং ইনফ্রারেড+টিভি ক্যামেরার সমন্বে গঠিত। কোনোভাবে এর রাডার জ্যাম হলেও ইনফ্রারেড সিস্টেম এবং টিভি ক্যামেরাকে চাইলেও জ্যাম করা সম্ভব না।
MIRADOR: এটি একটি ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল টার্গেটং এবং ট্রাকিং সিস্টেম যাতে একটি হাই রেজুলেশন ডে/নাইট ক্যামেরা থাকে যা সমুদ্র এবং আকাশে থাকা যেকোন টার্গেট কে ২৬ কিমি দূর থেকে খুজে বের করতে পারে।
TDS (Target Detection System): টার্গেট ডিটেকশন সিস্টেম বা TDS হলো এমন একটি ট্র্যাকিং ও ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম যা গানফায়ার এবং CIWS কন্ট্রোল এ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি একটি লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার সিস্টেম নিয়ে গঠিত যা লেজার দ্বারা টার্গেট কে ট্র্যাক করে তাকে ধ্বংস করতে অস্ত্রকে নির্দেশনা দিয়ে থাকে।
NBC Detection System: এই সিস্টেম টি জাহাজের আসে পাশে থাকা নিউক্লিয়ার বায়োক্যামিকাল সনাক্ত করতে পারে।
Combat Management System: উপরের কোন কিছুই সঠিক ভাবে কাজ করবে না যদি এই কমব্যাট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমটি না থাকে। এটি সেই সিস্টেম, যা অস্ত্র এবং সেন্সর এর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। আর এত কিছুর জন্য বিএনএস বঙ্গবন্ধু এখনো বাংলাদেশের ফ্ল্যাগশীপ।
বর্তমানে বিএনএস বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নেভির ফ্ল্যাগশিপ বা প্রধান যুদ্ধজাহাজ হিসেবে দায়িত্বরত আছে। এটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় নজরদারি করছে সেই সাথে চোরাচালান, নৌ-সন্ত্রাস ও অশুভ শক্তি দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এবং নৌপথে উদ্ধার অভিযানও পরিচালনা করছে ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিরপত্তায় এটি বিশেষ দায়িত্ব পালন করছে। যেকোনো সময় যেকোনো পরিস্থিতিতে বিএনএস বঙ্গবন্ধু দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সদা প্রস্তুত।
লেখায়ঃ উদয় দত্ত ও এডমিন কর্তৃক সংযোজিত।
Leave a Reply