২০০০ সালের ১২ আগস্ট অস্কার ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন কুরস্ক এক রহস্যজনক বিষ্ফোরণজনীত কারনে ১১৮ জন সাবমেরিন অফিসার এবং ক্রু, মিসাইল এবং টর্পেডো সহ এন্টার্কটিকা এবং নরওয়ের মাঝামাঝি ব্যারেন্টস সাগরের প্রায় ৩০০ মিটার নীচে ডুবে যায়।
সাবমেরিনটি ছিল লম্বায় ১৫৪ মিটার বা ৫০৫ ফুট। আর এর ওজন ছিলো সাকুল্যে ১৮০০০ টন।
দুর্ঘটনার কারণঃ
১২ ই আগস্ট ২০০০ সাল, সকালে একটা নৌ-যুদ্ধের মহড়ার অংশ হিসাবে কুরস্ক দ্বারা যুদ্ধজাহাজ ‘পিতর ভেলিকী‘ এর দিকে দুটি ডামি টর্পেডো নিক্ষেপ করার কথা ছিল।
সকাল ১১ টা ২৯ মিনিটে একটা ৬৫-৭৬ কীট টর্পেডো কুরস্ক এর ৪ নং টর্পেডো টিউবে ভরা হল। ঐ টর্পেডো টা ছিল অনেক পুরোনো। ওটার জ্বালানী তথা উচ্চমানের হাই টেস্ট পেরক্সাইড লীক করে বাইরে চলে আসে ফলে সৃস্টি হয় বিষ্ফোরনের আর ওটার ধাক্কা সম্মুখের কম্পার্টমেন্টে সরাসরি লাগে।
ফলে সেখানকার ৭ জন ক্রু সাথে সাথে মারা যায়। টর্পেডোর বিস্ফোরণের প্রভাবে সাথে থাকা বাকি টর্পেডো গুলিও বিস্ফোরিত হয় বিশাল বিষ্ফোরণের কারণে সাবমেরিনের সামনের অংশ কয়েক ভাগ হয়ে যায় রিখটার স্কেলে সেটার মান ছিল ৪.২ !
সামনের অংশ দ্বিতীয় ও তৃতীয় কম্পার্টমেন্ট থাকায় সেখানে ছিল কমান্ড পোস্ট, সেখানে সাথে সাথে মারা যায় কমান্ড পোস্টের ৪৬ জন অফিসার ও ক্রু।
৬ নং কম্পার্টমেন্টে ২৩ জন অফিসার আর ক্রু ছিল। তারা ক্যাপ্টেন লেঃ দিমিত্রি কলেশনিকভ এর নির্দেশে ৯নং কম্পার্টমেন্টে জড়ো হলেন। তারা চেক করে দেখেন বেরুবার রাস্তা সব বন্ধ। বাঁচার একমাত্র উপায় উদ্ধারকারী জাহাজ। অক্সিজেনও দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল, নতুন করে বানাবার যন্ত্র ও আছে কিন্ত কপাল খারাপ হলে যা হয় আরকি, অক্সিজেন তৈরী করার যন্ত্রটাও নস্ট হয়ে গিয়েছিল সেই সময় !
ক্রুদের সবাই ৮-১০ ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে ছিল তাদের ডায়েরি পড়ে সেরকমটাই জানা যায় পরে সবাই অক্সিজেনের অভাবে মারা যান যদিও মান বাঁচাবার জন্য রাশানরা তখন বলেছিল ক্রুরা সবাই সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় !
দুর্ঘটনার খবর শুনে আমেরিকা, বৃটেন এবং নরওয়ে উদ্ধারের সাহায্যের প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু নাক উঁচু রাশিয়া বিভিন্ন কারণে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কারণটা ছিল নিউক্লিয়ার সরঞ্জাম, টর্পেডো, তৈরীর কৌশল ইত্যাদি রক্ষার জন্য, অর্থাৎ যাতে বাইরের কেউ ওটা উদ্ধার করে তথ্য না জানতে পারে সেজন্য রাশিয়া নিজেই এটাকে উদ্ধারের পরিকল্পনা নেয়।
তবে সেরকম কারিগরি দক্ষতা রাশিয়ার নিজের না থাকায় তারা হল্যান্ডের একটা কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি করে। হল্যান্ডের দুটো কোম্পানী-
১) ম্যামোয়েট ট্রান্সপোর্ট বিভি
২) স্মিট লিঃ
একসাথে এটার জন্য কাজ করে।
২০০১ সালের ৭ ই অক্টোবর, দুর্ঘটনার প্রায় ১৪ মাস পরে হল্যান্ডের কোম্পানী দুটো তাদের উদ্ধার অপারেশন শুরু করে। উল্লেখ্য এধরনের কাজে তারাই ছিল পৃথিবীর অন্যতম সেরা।
আঠার হাজার টনের একটা সাবমেরিন পানির নীচ থেকে টেনে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর আবার এটাতে প্রচুর টর্পেডো আর নিউক্লিয়ার মিসাইল ছিল।
কাদায় জুতা আটকে গেলে ওজন অনেক বেশি হয়ে যায়, এটাও সেরকম হয়েছিল, ওজন হয়ে গেছিল প্রায় ৩৫০০০ টন !
ছবিতে দেখলেন সামনের অংশ ভাংগা, সুতরাং পেচিয়ে টেনে তোলা ছিল বিপদজনক, সামনের অংশ ভেংগে পড়ে গেলে ভারসাম্য হারিয়ে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্ভবনা থেকে যায়।
ডাচ কোম্পানী এটার খোলে উচ্চচাপের পানির জেট দিয়ে ২৬ টা ফুটো করে সেখানে লোহার লকিং পিন ঢুকিয়ে ২৬ টা স্টীলের তারের সাহায্যে উপরে থেকে টেনে তুলে উদ্ধার করে।
প্রতিটা ফুটো প্রায় ১ মিটার ব্যাসার্ধের ছিল।
এর পর এটাকে পানির নীচে রেখেই শক্তিশালী ক্রেনের সাহায্যে টেনে ২২৫ মাইল দুরে রাশিয়ার মামোয়ের্স্ক নামক বন্দরে নিয়ে রাখে। সেখানে এটাকে পুরোপুরি খুলে ফেলা হয়। একেকটা ক্রেনের স্টিলের তারের ৬০০০ টন পর্যন্ত টেনে তুলবার ক্ষমতা বা লিফটিং ক্যাপাসিটি ছিল !
পৃথিবীর ইতিহাসে ওটাই ছিল প্রথম ঐ ধরনের অতো বড় অপারেশন। অবশ্য এর পরে আর অতো বড় দুর্ঘটনা ঘটেনি সুতরাং অপারেশনের আর দরকারই পড়েনি।

টর্পেডোর আঘাতে ভেঙ্গে যাওয়া সামনের অংশ

দুর্ঘটনার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত সাবমেরিন

দুর্ঘটনার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত সাবমেরিন

সাবমেরিন দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ
Leave a Reply